পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৸৶৹
মহাভারত

নিজেও ঈর্ষা ও বিদ্বেষে দগ্ধ হয়েছেন, তাঁর দুই মন্ত্রণাদাতা কর্ণ ও শকুনি তাতে ইন্ধন যুগিয়েছেন। দুর্যোধন নিয়তিবাদী। সভাপর্বে তিনি বিদুরকে বলেছেন, ‘যিনি গর্ভস্থ শিশুকে শাসন করেন তিনিই আমার শাসক; তাঁর প্রেরণায় আমি জলস্রোতের ন্যায় চালিত হচ্ছি।’ উদ্‌যোগপর্বে কণ্ব মুনি তাঁকে সদুপদেশ দিলে দুর্যোধন ঊরুতে চাপড় মেরে বললেন, ‘মহর্ষি, ঈশ্বর আমাকে যেমন সৃষ্টি করেছেন এবং ভবিষ্যতে আমার যা হবে আমি সেই ভাবেই চলছি, কেন প্রলাপ বকছেন?’ কিন্তু শয়তানকেও তার ন্যায্য পাওনা দিতে হয়। দুর্যোধনের অন্ধকারময় চরিত্রে আমরা একবার একটু স্নিগ্ধ আলোক দেখতে পাই।—দ্রোণবধের দিন প্রাতঃকালে সাত্যকিকে দেখে তিনি বলেছেন, ‘সখা, ক্রোধ লোভ ক্ষত্রিয়াচার ও পৌরুষকে ধিক—আমরা পরস্পরের প্রতি শরসন্ধান করছি! বাল্যকালে আমরা পরস্পরের প্রাণ অপেক্ষা প্রিয় ছিলাম, এখন এই রণস্থলে সে সমস্তই জীর্ণ হয়ে গেছে। সাত্যকি, আমাদের সেই বাল্যকালের খেলা কোথায় গেল, এই যুদ্ধই বা কেন হ’ল? যে ধনের লোভে আমরা যুদ্ধ করছি তা নিয়ে আমরা কি করব?’ আশ্রমবাসিকপর্বে প্রজাদের নিকট বিদায় নেবার সময় ধৃতরাষ্ট্র তাঁর মৃত পুত্রের সপক্ষে বলেছেন, ‘মন্দবুদ্ধি দুর্যোধন আপনাদের কাছে কোনও অপরাধ করে নি।’ প্রজাদের যিনি মুখপাত্র তিনিও স্বীকার করলেন, ‘রাজা দুর্যোধন আমাদের প্রতি কোনও দুর্ব্যবহার করেন নি।’ যুধিষ্ঠির স্বর্গে গিয়ে দুর্যোধনকে দেখে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। নারদ তাঁকে প্রবোধ দিয়ে বললেন, ‘ইনি ক্ষত্রধর্মানুসারে যুদ্ধে নিজ দেহ উৎসর্গ ক’রে বীরলোক লাভ করেছেন, মহাভয় উপস্থিত হ’লেও ইনি কখনও ভীত হন নি।’ আসল কথা, দুর্যোধন লৌকিক ফরমূলা অনুসারে স্বর্গে গেছেন। যুদ্ধে মরলে স্বর্গ, অশ্বমেধে স্বর্গ, গঙ্গাস্নানে স্বর্গ; আজীবন কে কি করেছে তা ধর্তব্য নয়।

 বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, ‘কর্ণচরিত্র অতি মহৎ ও মনোহর।’ তিনি কর্ণের গুণাগুণের জমাখরচ ক’ষে সদ্‌গুণাবলীর মোটা রকম উদ্‌বৃত্ত পেয়েছিলেন কিনা জানি না। আমরা কর্ণচরিত্রে নীচতা ও মহত্ত্ব দুইই দেখতে পাই (নীচতাই বেশী), কিন্তু তার সমন্বয় করতে পারি না। বোধ হয় বহু রচয়িতার হাতে পড়ে কর্ণচরিত্রের এই বিপর্যয় হয়েছে। কর্ণপর্ব ১৮-পরিচ্ছেদে অর্জুনকে কৃষ্ণ বলেছেন, ‘জতুগৃহদাহ, দ্যূতক্রীড়া, এবং দুর্যোধন তোমাদের উপর যত উৎপীড়ন করেছেন সে সমস্তেরই মূল দুরাত্মা কর্ণ।’ কৃষ্ণ অত্যুক্তি করেন নি।

 মহাভারতে সব চেয়ে রহস্যময় পুরুষ কৃষ্ণ। বহু হস্তক্ষেপের ফলে তাঁর চরিত্রেই বেশী অসংগতি ঘটেছে। মূল মহাভারতের রচয়িতা কৃষ্ণকে ঈশ্বর বললেও সম্ভবত তাঁর আচরণে অতিপ্রাকৃত ব্যাপার বেশী দেখান নি। সাধারণত তাঁর আচরণ গীতাধর্মব্যাখ্যাতারই যোগ্য, তিনি বীতরাগভয়ক্রোধ স্থিতপ্রজ্ঞ লোকহিতে রত। কিন্তু মাঝে মাঝে তাঁর যে বিকার দেখা যায় তা ধর্মসংস্থাপক পুরুষোত্তমের পক্ষে নিতান্ত অশোভন, যেমন ঘটোৎকচবধের পর তাঁর উদ্দাম নৃত্য এবং দ্রোণবধের