পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/১৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৩০
মহাভারত

গেলেই শত্রু সৃষ্টি হয়। যে লোক শত্রুর দলভুক্ত তাকে গৃহে বাস করতে দেওয়া অনুচিত। বিদুর, আপনি যেখানে ইচ্ছা চ’লে যান।

 বিদুর বললেন, রাজপুত্র, ষাট বৎসরের পতি যেমন কুমারীর কাম্য নয়, আমিও সেইরূপ তোমার অপ্রিয়। এর পরে যদি হিতাহিত সকল বিষয়ে নিজের মনোমত মন্ত্রণা চাও তবে স্ত্রী জড় পঙ্গু ও মূঢ়দের জিজ্ঞাসা ক’রো। প্রিয়ভাষী পাপী লোক অনেক আছে কিন্তু অপ্রিয় হিতবাক্যের বক্তা আর শ্রোতা দইই দুর্লভ। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, আমি সর্বদাই বিচিত্রবীর্যের বংশধরদের যশ ও ধন কামনা করি। যা হবার তা হবে, আপনাকে নমস্কার করি, ব্রাহ্মণেরা আমাকে আশীর্বাদ করুন।

 শকুনি বললেন, যুধিষ্ঠির, তুমি পাণ্ডবদের বহু সম্পত্তি হেরেছ, আর যদি কিছু থাকে তো বল। যুধিষ্ঠির বললেন, সুবলনন্দন, আমার ধন অসংখ্য, তাই নিয়ে আমি খেলব। এই ব’লে তিনি পণ করলেন—অসংখ্য অশ্ব গো ছাগ মেষ এবং পর্ণাশা ও সিন্ধু নদীর পূর্বপারের সমস্ত সম্পত্তি; নগর, জনপদ, ব্রহ্মস্ব ভিন্ন সমস্ত ধন ও ভূমি, ব্রাহ্মণ ভিন্ন সমস্ত পুরুষ। শকুনি সবই জিতে নিলেন। তখন যুধিষ্ঠির রাজপুত্রগণের কুণ্ডলাদি ভূষণ পণ করলেন এবং তাও হারলেন। তার পর তিনি বললেন, এই শ্যামবর্ণ লোহিতাক্ষ সিংহস্কন্ধ মহাবাহু যুবা নকুল আমার পণ। শকুনি নকুলকে এবং তার পর সহদেবকেও জয় ক’রে বললেন, যুধিষ্ঠির, তোমার প্রিয় দুই মাদ্রীপুত্রকে আমি জিতেছি, বোধ হয় ভীম আর অর্জুন তোমার আরও প্রিয়।

 যুধিষ্ঠির বললেন, মূঢ়, তুমি আমাদের মধ্যে ভেদ জন্মাতে চাচ্ছ। শকুনি বললেন, মত্ত লোক গর্তে পড়ে, প্রমত্ত লোক বহুভাষী হয়। তুমি রাজা এবং বয়সে বড়, তোমাকে নমস্কার করি। লোকে জুয়াখেলার সময় অনেক উৎকট কথা বলে[১]

 যুধিষ্ঠির বললেন, শকুনি, যিনি যুদ্ধে নৌকার ন্যায় আমাদের পার করেন, যিনি শত্রুজয়ী ও বলিষ্ঠ, পণের অযোগ্য সেই রাজপুত্র অর্জুনকে পণ রাখছি। শকুনি পাশা ফেলে বললেন, জিতেছি। যুধিষ্ঠির বললেন, বজ্রধারী ইন্দ্রের ন্যায় যিনি যুদ্ধে আমাদের নেতা, যিনি তির্যক্‌প্রেক্ষী[২] সিংহষ্কন্ধ ক্রুদ্ধস্বভাব, যাঁর তুল্য বলবান কেউ নেই, পণের অযোগ্য সেই ভীমসেনকে পণ রাখছি। শকুনি পাশা ফেলে বললেন, জিতেছি। অবশেষে যুধিষ্ঠির নিজেকেই পণ রাখলেন এবং হারলেন।


  1. অর্থাৎ আমার কথায় রাগ ক’রো না।
  2. যাঁর চক্ষু বা দৃষ্টি বাঁকা।