পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/১৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৩২
মহাভারত

সদস্যগণকে জিজ্ঞাসা কর, ধর্মানুসারে আমার কর্তব্য কি। তাঁরা যা বলবেন আমি তাই করব। প্রাতিকামী সভায় ফিরে এসে দ্রৌপদীর প্রশ্ন জানালে সকলে অধোমুখে নীরবে রইলেন। এই সময়ে যুধিষ্ঠির একজন বিশ্বস্ত দূতকে দিয়ে দ্রৌপদীকে ব’লে পাঠালেন, পাঞ্চালী, তুমি এখন রজস্বলা একবস্ত্রা, এই অবস্থাতেই কাঁদতে কাঁদতে সভায় এসে শ্বশুরের সম্মুখে দাঁড়াও।

 দুর্যোধন পুনর্বার প্রাতিকামীকে বললেন, দ্রৌপদীকে নিয়ে এস। প্রাতিকামী ভীত হয়ে বললে, তাঁকে কি বলব? দুর্যোধন বললেন, এই সূতপুত্র ভীমের ভয়ে উদ্‌বিগ্ন হয়েছে। দুঃশাসন, তুমি নিজে দ্রৌপদীকে ধ’রে নিয়ে এস। দুঃশাসন দ্রৌপদীর কাছে গিয়ে বললেন, পাঞ্চালী, তুমি বিজিত হয়েছে, লজ্জা ত্যাগ ক’রে দুর্যোধনের সঙ্গে দেখা কর, কৌরবগণকে ভজনা কর। দ্রৌপদী ব্যাকুল হয়ে বেগে ধৃতরাষ্ট্রের পত্নীদের কাছে চললেন, কিন্তু দুঃশাসন তর্জন করে তাঁর কেশ ধরলেন যে কেশ রাজসূয় যজ্ঞের মন্ত্রপূত জলে সিক্ত হয়েছিল। দুঃশাসনের আকর্ষণে নতদেহ হয়ে দ্রৌপদী বললেন, মন্দবুদ্ধি অনার্য, আমি একবস্ত্রা রজস্বলা, আমাকে সভায় নিয়ে যেয়ো না। দুঃশাসন বললেন, তুমি রজস্বলা একবস্ত্রা বা বিবস্ত্রা যাই হও, দ্যূতে বিজিত হয়ে দাসী হয়েছে, আমাদের ভজনা কর।

 বিক্ষিপ্তকেশে অর্ধস্খলিতবসনে দ্রৌপদী সভায় আনীত হলেন। লজ্জায় ও ক্রোধে দগ্ধ হ’য়ে তিনি ধীরে ধীরে বললেন, দুঃশাসন, ইন্দ্রাদি দেবগণও যদি তোমার সহায় হন তথাপি পাণ্ডবগণ তোমাকে ক্ষমা করবেন না। এই কুরুবীরগণের মধ্যে আমাকে টেনে আনা হ’ল কিন্তু কেউ তার নিন্দা করছেন না! ভীষ্ম দ্রোণ বিদুর আর রাজা ধৃতরাষ্ট্রের কি প্রাণ নেই? কুরুবৃদ্ধগণ এই দারুণ অধর্মাচার কি দেখতে পাচ্ছেন না? ধিক, ভরতবংশের ধর্ম আর চরিত্র নষ্ট হয়েছে, এই সভায় কৌরবগণ কুলধর্মের মর্যাদালঙ্ঘন নীরবে দেখছেন। দ্রৌপদী করুণম্বরে এইরূপে বিলাপ ক’রে বক্রনয়নে পতিদের দিকে তাকাচ্ছেন দেখে দুঃশাসন তাঁকে ধাক্কা দিয়ে সশব্দে হেসে বললেন, দাসী! কর্ণও হৃষ্ট হ’য়ে অট্টহাস্য করলেন, শকুনিও অনুমোদন করলেন।

 সভাস্থ আর সকলেই অত্যন্ত ব্যথিত হলেন। ভীষ্ম বললেন, ভাগ্যবতী, ধর্মের তত্ত্ব অতি সূক্ষ্ম, আমি তোমার প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিতে পারছি না। যুধিষ্ঠির সব ত্যাগ করলেও সত্য ত্যাগ করেন না, তিনিই বলেছেন—আমি বিজিত হয়েছি। দ্যূতক্রীড়ায় শকুনি অদ্বিতীয়, তাঁর জন্যই যুধিষ্ঠিরের খেলার ইচ্ছা হয়েছিল। শকুনি শঠতা অবলম্বন করেছেন যুধিষ্ঠির এমন মনে করেন না। দ্রৌপদী বললেন, যুধিষ্ঠিরে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ধূর্ত দুষ্ট শঠ লোকে তাঁকে এই সভায়