পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা
৸৶৹

উদ্দেশ্যে যুধিষ্ঠিরকে মিথ্যাভাষণের উপদেশ। বঙ্কিমচন্দ্র যা কিছউ অপ্রিয় পেয়েছেন সবই প্রক্ষেপ ব’লে উড়িয়ে দিয়ে কৃষ্ণকে আদর্শনরধর্মী ঈশ্বর ব’লে মেনেছেন। শান্তিপর্বে যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নের উত্তরে ভীষ্ম বলেছেন, ‘এই মহাত্মা কেশব সেই পরম পুরুষের অষ্টমাংশ।’ মৃত্যুর পূর্বে তিনি কৃষ্ণকে বলেছেন, ‘তুমি সনাতন পরমাত্মা।’ অর্জুন কৃষ্ণকে ঈশ্বর জ্ঞান করলেও সব সময়ে তা মনে রাখতেন না। কৃষ্ণের বিশ্বরূপদর্শনে অভিভূত হয়ে অর্জুন বলেছেন, ‘তোমার মহিমা না জেনে প্রমাদবশে বা প্রণয়বশে তোমাকে কৃষ্ণ যাদব ও সখা ব’লে সম্বোধন করেছি, বিহার ভোজন ও শয়ন কালে উপহাস করেছি, সে সমস্ত ক্ষমা কর।’ স্বামী প্রভবানন্দ ও ক্রিস্টফার ইশারউড তাঁদের গীতার মুখবন্ধে লিখেছেন, ‘Arjuna knows this—yet, by a merciful ignorance, he sometimes forgets. Indeed, it is Krishna who makes him forget, since no ordinary man could bear the strain of constant companionship with God.’ মহাভারতপাঠে বোঝা যায় কৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব বহুবিদিত ছিল না। কৃষ্ণপুত্র শাম্ব দুর্যোধনের জামাতা; দুর্যোধন তাঁর বৈবাহিককে ঈশ্বর মনে করতেন না। উদ্‌যোগপর্বে তিনি যখন পাণ্ডবদূত কৃষ্ণকে বন্দী করবার মতলব করছিলেন তখন কৃষ্ণ সভাস্থ সকলকে তাঁর বিশ্বরূপ দেখালেন, কিন্তু তাতেও দুর্যোধনের বিশ্বাস হ’ল না। যুদ্ধের পূর্বে শকুনিপুত্র উলূককে তাঁর প্রতিনিধিরূপে পাণ্ডবশিবিরে পাঠাবার সময় দুর্যোধন তাঁকে শিখিয়ে দিলেন—‘তুমি কৃষ্ণকে বলবে,···ইন্দ্রজাল মায়া কুহক বা বিভীষিকা দেখলে অস্ত্রধারী বীর ভয় পায় না, সিংহনাদ করে। আমরাও বহুপ্রকার মায়া দেখাতে পারি, কিন্তু তেমন উপায়ে কার্যসিদ্ধি করতে চাই না। কৃষ্ণ, তুমি অকস্মাৎ যশস্বী হয়ে উঠেছ, কিন্তু আমরা জানি পংশ্চিহ্ণধারী নপুংসক অনেক আছে। তুমি কংসের ভৃত্য ছিলে সেজন্য আমার তুল্য কোনও রাজা তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করেন নি।’ সর্বত্র ঈশ্বররূপে স্বীকৃত না হ’লেও কৃষ্ণ বহু সমাজে অশেষ শ্রদ্ধা ও প্রীতির আধার ছিলেন এবং রূপ শৌর্য বিদ্যা ও প্রজ্ঞার জন্য পুরুষশ্রেষ্ঠ গণ্য হ’তেন। তিনি রাজা নন, যাদব অভিজাততন্ত্রের একজন প্রধান মাত্র, কিন্তু প্রতিপত্তিতে সর্বত্র শীর্ষস্থানীয়। তথাপি কৃষ্ণদ্বেষীর অভাব ছিল না। সভাপর্ব ৩-পরিচ্ছেদে উক্ত বঙ্গ-পুণ্ড্র-কিরাতের রাজা পৌণ্ড্রক কৃষ্ণের অনুকরণে শঙ্খ চক্র গদা ধারণ করতেন এবং প্রচার করতেন যে তিনিই আসল বাসুদেব ও পুরুষোত্তম।

 অল্প বা অধিক যাই হ’ক, মহাভারতের ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে তা সর্বস্বীকৃত। আখ্যানমধ্যে বহু বিষয়ের উল্লেখ পাওয়া যায় যার সত্যতায় সন্দেহের কারণ নেই। দ্রৌপদীর বহুপতিত্বের দোষ ঢাকবার জন্য গ্রন্থকারকে বিশেষ চেষ্টা করতে হয়েছে। তিনি যদি শুধু গল্পই লিখতেন তবে এই লোকাচারবিরুদ্ধে বিষয়ের