পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/১৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
সভাপর্ব
১৩৭

আবার তাঁকে দ্যূতক্রীড়ায় আহ্বান করেছেন। যুধিষ্ঠির বললেন, বিধাতার নিয়োগ অনুসারেই জীবের শুভাশুভ ঘটে। বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র যখন ডেকেছেন তখন বিপদ হবে জেনেও আমাকে যেতে হবে। রাম জানতেন যে স্বর্ণময় জন্তু অসম্ভব, তথাপি তিনি স্বর্ণমৃগ দেখে লুব্ধ হয়েছিলেন। বিপদ আসন্ন হ’লে লোকের বুদ্ধির বিপর্যয় হয়।

 যুধিষ্ঠির দ্যূতসভায় উপস্থিত হ’লে শকুনি বললেন, বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র তোমাদের ধন ফিরিয়ে দিয়ে মহৎ কার্য করেছেন। এখন যে পণ রেখে আমরা খেলব তা শোন।—আমরা যদি হারি তবে মৃগচর্ম পরিধান ক’রে দ্বাদশ বর্ষ মহারণ্যে বাস করব, তার পর এক বৎসর স্বজনবর্গের অজ্ঞাত হয়ে থাকব। যদি অজ্ঞাতবাসকালে কেউ আমাদের সন্ধান পায় তবে আবার দ্বাদশ বর্ষ বনবাস করব। যদি তোমরা হেরে যাও তবে তোমরাও এই নিয়মে বনবাস ও অজ্ঞাতবাস করবে, এবং ত্রয়োদশ বৎসরের শেষে স্বরাজ্য পাবে। এখন খেলবে এস।

 সভাস্থ সকলে উদ্‌বিগ্ন হয়ে হাত তুলে বললেন, আত্মীয়দের ধিক, তাঁরা পাণ্ডবদের সাবধান করে দিচ্ছেন না, পাণ্ডবরাও তাঁদের বিপদ বুঝছেন না। যুধিষ্ঠির বললেন, আমি স্বধর্মনিষ্ঠ, দ্যূক্রীড়ায় আহূত হ’লে নিবৃত্ত হই না। শকুনি, আমি আপনার সঙ্গে খেলব। শকুনি তাঁর পাশা ফেলে বললেন, জিতেছি।

 পরাজিত পাণ্ডবগণ মৃগচর্মের উত্তরীয় ধারণ ক’রে বনবাসের জন্য প্রস্তুত হলেন। দুঃশাসন বললেন, এখন দুর্যোধন রাজচক্রবর্তী হলেন, পাণ্ডবগণ সুদীর্ঘকালের জন্য নরকে পতিত হ’ল। ক্লীব পাণ্ডবদের কন্যাদান ক’রে দ্রুপদ ভাল করেন নি। দ্রৌপদী, এই পতিত স্বামীদের সেবা ক’রে তোমার আর লাভ কি? ভীম বললেন, নিষ্ঠুর, তুমি এখন বাক্যবাণে আমাদের মর্মভেদ করছ, এই কথা যুদ্ধক্ষেত্রে তোমার মর্মস্থান ছিন্ন ক’রে মনে করিয়ে দেব। নির্লজ্জ দুঃশাসন ‘গরু, গরু’ ব’লে ভীমের চারিদিকে নাচতে লাগলেন।

 পাণ্ডবগণ সভা থেকে নির্গত হলেন। দুর্বুদ্ধি দুর্যোধন হর্ষে অধীর হয়ে ভীমের সিংহগতির অনুকরণ করতে লাগলেন। ভীম পিছন ফিরে বললেন, মূঢ় দুর্যোধন, দুঃশাসনের বিদীর্ণ বক্ষের শোণিত পান করলেই আমার কর্তব্য শেষ হবে না, তোমাকে সদলে নিহত ক’রে প্রতিশোধ নেব। আমি গদাঘাতে তোমাকে মারব, পদাঘাতে তোমার মস্তক ভূলুণ্ঠিত করব। অর্জুন কর্ণকে আর সহদেব ধূর্ত শকুনিকে মারবেন, আর এই বাক্যবীর দুরাত্মা দুঃশাসনের রক্ত আমি সিংহের ন্যায় পান করব।