পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/১৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৪২
মহাভারত

 পরদিন প্রভাতকালে যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণদের বললেন, আমরা হৃতসর্বস্ব হয়ে দুঃখিতমনে বনে যাচ্ছি, সেখানে ফলমূল আর মাংস খেয়ে থাকব। হিংস্রপ্রাণিসমাকুল বনে বহু কষ্ট, আপনারা এখন ফিরে যান। ব্রাহ্মণেরা বললেন, রাজা, আপনার যে গতি আমাদেরও সেই গতি হবে। আমাদের ভরণপোষণের জন্য ভাববেন না, নিজেরাই আহার সংগ্রহ ক’রে নেব। আমরা ধ্যান ও জপ ক’রে আপনার মঙ্গলবিধান করব, মনোহর কথায় চিত্তবিনোদন করব। যুধিষ্ঠির বললেন, আপনারা আহার সংগ্রহ ক’রে ভোজন করবেন তা আমি কি ক’রে দেখব? আপনারা ক্লেশভোগের যোগ্য নন। ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের ধিক, আমাদের প্রতি স্নেহবশেই আপনারা ক্লেশভোগ করতে চাচ্ছেন।

 যোগ ও সাংখ্য শাস্ত্রে বিশারদ শৌনক নামক এক ব্রাহ্মণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, রাজা, সহস্র শোকস্থান[১] আছে, শত ভয়স্থান[১] আছে, মূর্খরাই প্রতিদিন তাতে অভিভূত হয়, পণ্ডিতজন হন না। শাস্ত্রসম্মত অমঙ্গলনাশিনী বুদ্ধি আপনার আছে, অর্থ কষ্ট, দুর্গমস্থানে বাস বা স্বজনবিচ্ছেদের জন্য শারীরিক বা মানসিক দুঃখে অবসন্ন হওয়া আপনার উচিত নয়। মহাত্মা জনক বলেছেন, রোগ, শ্রম, অপ্রিয় বিষয়ের প্রাপ্তি ও প্রিয় বিষয়ের বিরহ, এই চার কারণে শারীরিক দুঃখ উৎপন্ন হয়। শারীরিক দুঃখের প্রতিবিধান করা এবং মানসিক দুঃখ সম্বন্ধে চিন্তা না করাই দুঃখনিবৃত্তির উপায়। অগ্নি যেমন জলে নির্বাপিত হয় সেইরূপ জ্ঞান দ্বারা মানসিক দুঃখ দূরীকৃত হয়, মন প্রশান্ত হ’লে শারীরিক কষ্টেরও উপশম হয়। স্নেহ[২]ই মানসিক দঃখের মূল, দুঃখ ভয় শোক হর্ষ আয়াস সবই স্নেহ থেকে উৎপন্ন। জ্ঞানী যোগী ও শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি স্নেহে লিপ্ত হন না। আপনি কোনও বিষয় স্পৃহা করবেন না, যদি ধর্ম চান তবে স্পৃহা ত্যাগ করুন।

 যুধিষ্ঠির বললেন, ব্রাহ্মণদের ভরণের জন্যই আমি অর্থ কামনা করি, আমার নিজের লোভ নেই। অনুগত জনকে পালন না ক’রে আমার ন্যায় গৃহাশ্রমবাসী কি ক’রে থাকতে পারে? তৃণাসন ভূমি জল ও মধুর বাক্য, এই চারটির অভাব সজ্জনের গৃহে কখনও হয় না। আর্ত ব্যক্তিকে শয্যা, শ্রান্তকে আসন, তৃষিতকে জল এবং ক্ষুধিতকে আহার দিতে হবে। গৃহস্থের পক্ষে এইরূপ আচরণই পরম ধর্ম।

 শৌনক বললেন, মহারাজ এই বেদবচন আছে—কর্ম কর, ত্যাগও কর;

  1. ১.০ ১.১ শোক ও ভয়ের কারণ।
  2. অনুরাগ, আসক্তি।