পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৲
মহাভারত

অবতারণা করতেন না। তাঁকে সুপ্রতিষ্ঠিত জনশ্রুতি বা ইতিহাস মানতে হয়েছে তাই তিনি এই ঘটনাটি বাদ দিতে পারেন নি। আখ্যানের মধ্যে দ্রোণপত্নী কৃপীর উল্লেখ অতি অল্প, তথাপি প্রসঙ্গক্রমে তাঁকে অল্পকেশী বলা হয়েছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন কৃষ্ণবর্ণ ছিলেন, তাঁর রূপ বেশ ও গন্ধ কুৎসিত ছিল, ভীম মাকুন্দ ছিলেন, মাহিষ্মতী পুরীর নারীরা স্বৈরিণী ছিল, মদ্র ও বাহীক দেশের স্ত্রীপরুষ অত্যন্ত কদাচারী ছিল, যাদবগণ মাতাল ছিলেন, হিমালয়ের উত্তরে বালুকার্ণব ছিল, লৌহিত্য (ব্রহ্মপুত্র নদ) এত বিশাল ছিল যে তাকে সাগর বলা হ’ত, দ্বারকাপুরী সাগরকবলিত হয়েছিল—ইত্যাদি তুচ্ছ ও অতুচ্ছ অনেক বিষয় গ্রন্থমধ্যে বিকীর্ণ হয়ে আছে যা সত্য বলে মানতে বাধা হয় না।

 মহাভারত পড়লে প্রাচীন সমাজ ও জীবনযাত্রার একটা মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায়। ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়াদি সকলেই প্রচুর মাংসাহার করতেন, ভদ্রসমাজেও সুরাপান চলত। গোমাংসভোজন ও গোমেধ যজ্ঞের বহু উল্লেখ পাওয়া যায়, কিন্তু গ্রন্থরচনাকালে তা গর্হিত গণ্য হ’ত। অস্পৃশ্যতা কম ছিল, দাসদাসীরাও অন্ন পরিবেশন করত! অনুশাসনপর্বে ভীষ্ম বলেছেন, ৩০ বা ২১ বৎসরের বর ১০ বা ৭ বৎসরের কন্যাকে বিবাহ করবে; কিন্তু পরে আবার বলেছেন, বয়স্থা কন্যাকে বিবাহ করাই বিজ্ঞলোকের উচিত। মহাভারতে সর্বত্র যুবতীবিবাহই দেখা যায়। রাজাদের অনেক পত্নী এবং দাসী বা উপপত্নী থাকত, যাঁর এক ভার্যা তিনি মহাসুকৃতিশালী গণ্য হতেন। বর্ণসংকরত্বের ভয় ছিল, কিন্তু অনুশাসনপর্বে ভীষ্ম বহুপ্রকার বর্ণসংকরের উল্লেখ ক’রে বলেছেন, তাদের সংখ্যার ইয়ত্তা নেই। অনেক বিধবা সহমৃতা হতেন, আবার অনেকে পুত্রপৌত্রাদির সঙ্গে থাকতেন, যেমন সত্যবতী কুন্তী উত্তরা সুভদ্রা। নারীর মর্যাদার অভাব ছিল না, কিন্তু সময়ে সময়ে তাঁদেরও দানবিক্রয় এবং জুয়াখেলায় পণ রাখা হ’ত। ভূমি ধনরত্ন বস্ত্র যানবাহন প্রভৃতির সঙ্গে রূপবতী দাসীও দান করার প্রথা ছিল। উৎসবে শোভাবৃদ্ধির জন্য বেশ্যার দল নিযুক্ত হ’ত। ব্রাহ্মণরা প্রচুর সম্মান পেতেন; তাঁরা সভায় তুমুল তর্ক করতেন ব’লে লোকে উপহাসও করত। দেবপ্রতিমার পূজা প্রচলিত ছিল। রাজাকে দেবতুল্য জ্ঞান করা হ’ত, কিন্তু অনুশাসনপর্বে ১৩-পরিচ্ছেদে ভীষ্ম বলেছেন, যিনি প্রজারক্ষার আশ্বাস দিয়ে রক্ষা করেন না সেই রাজাকে ক্ষিপ্ত কুক্কুরের ন্যায় বিনষ্ট করা উচিত।’ অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান অতি বীভৎস ছিল। পুরাকালে নরবলি চলত, মহাভারতের কালে তা নিন্দিত হ’লেও লোপ পায় নি, জরাসন্ধ তার আয়োজন করেছিলেন।

 যুদ্ধের বর্ণনা অতিরঞ্জিত হ’লেও আমরা তৎকালীন যুদ্ধরীতির কিছু কিছু আন্দাজ করতে পারি। ভীষ্মপর্ব ১-পরিচ্ছেদে কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের যে নিয়মবন্ধন বিবৃত হয়েছে তা আধুনিক সার্বজাতিক নিয়ম অপেক্ষা নিকৃষ্ট নয়। নিরস্ত্র বা