পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/১৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৫০
মহাভারত

যে তোমাকে শেষ করে সে আমাকেও করে, যে তোমার অনুগত সে আমারও অনুগত। তুমি নর আর আমি নারায়ণ ঋষি ছিলাম, আমরা এখন নরলোকে এসেছি।

 শরণার্থিনী দ্রৌপদী পুণ্ডরীকাক্ষকে বললেন, হৃষীকেশ, ব্যাস বলেছেন তুমি দেবগণেরও দেব। তুমি সর্বভূতের ঈশ্বর, সেজন্য প্রণয়বশে আমি তোমাকে দুঃখ জানাচ্ছি। আমি পাণ্ডবগণের ভার্যা, তোমার সখী, ধৃষ্টদ্যুম্নের ভগিনী; দুঃশাসন কেন আমাকে কুরুসভায় টেনে নিয়ে গিয়েছিল? আমার একমাত্র বস্ত্র শোণিতসিক্ত, আমি লজ্জায় কাঁপছি, আমাকে দেখে পাপাত্মা ধার্তরাষ্ট্রগণ হেসে উঠল। পাণ্ডুর পঞ্চপুত্র, পাঞ্চালগণ ও বৃষ্ণিগণ জীবিত থাকতে তারা আমাকে দাসীরূপে ভোগ করতে চেয়েছিল। ধিক পাণ্ডবগণ, ধিক ভীমসেনের বল, ধিক অর্জুনের গাণ্ডীব! তাঁদের ধর্ম—পত্নীকে যখন নীচজন পীড়ন করছিল তখন তাঁরা নীরবে দেখছিলেন। স্বামী দুর্বল হ’লেও স্ত্রীকে রক্ষা করে, এই সনাতন ধর্ম। পাণ্ডবরা শরণাপন্নকে ত্যাগ করেন না, কিন্তু আমাকে রক্ষা করেন নি। কৃষ্ণ, আমি বহু ক্লেশ পেয়ে আর্যা কুন্তীকে ছেড়ে পুরোহিত ধৌম্যের আশ্রয়ে বাস করছি। আমি যে নির্যাতন ভোগ করেছি তা এই সিংহবিক্রান্ত বীরগণ কেন উপেক্ষা করছেন? দেবতার বিধানে মহৎ কুলে আমার জন্ম, আমি পাণ্ডবদের প্রিয়া ভার্যা, মহাত্মা পাণ্ডুর পুত্রবধূ, তথাপি পঞ্চপাণ্ডবের সমক্ষেই দুঃশাসন আমার কেশাকর্ষণ করেছিল।

 মৃদুভাষিণী কৃষ্ণা পদ্মকোষতুল্য হস্তে মুখ আবৃত ক’রে সরোদনে বললেন, মধুদসূদন, আমার পতি নেই, পুত্র নেই, বান্ধব ভ্রাতা পিতা নেই, তুমিও নেই। ক্ষুদ্রেরা আমাকে নির্যাতিত করেছে, কর্ণ আমাকে উপহাস করেছে, তোমরা তার কোনও প্রতিকার করছ না। কেশব, আমার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক[১] আছে, তোমার যশোগৌরব আছে, তুমি সখা ও প্রভু[২], এই চার কারণে আমাকে রক্ষা করা তোমার উচিত।

 কৃষ্ণ বললেন, ভাবিনী, তুমি যাদের উপর ক্রুদ্ধ হয়েছ তারা অর্জুনের শরে আচ্ছন্ন হয়ে রক্তাক্তদেহে ভূমিতে শোবে, তা দেখে তাদের ভার্যারা রোদন করবে। পাণ্ডবদের জন্য যা সম্ভবপর তা আমি করব, তুমি শোক ক’রো না। কৃষ্ণা, আমি সত্য প্রতিজ্ঞা করছি, তুমি রাজগণের রাজ্ঞী হবে। যদি আকাশ পতিত হয়, হিমালয় শীর্ণ হয়, পৃথিবী খণ্ড খণ্ড হয়, সমুদ্র শুষ্ক হয়, তথাপি আমার বাক্য ব্যর্থ হবে না।

 দ্রৌপদী অর্জুনের দিকে বক্র দৃষ্টিপাত করলেন। অর্জুন তাঁকে বললেন,

  1. কৃষ্ণ দ্রৌপদীর মামাতো দেওর।
  2. নিগ্রহ-অনুগ্রহ-সমর্থ।