পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/২৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বনপর্ব
২৪১

ধর্মাত্মা মুনি ছিলেন, তিনি কপোতের ন্যায় শিলোঞ্ছ[১] বৃত্তি অবলম্বন করে জীবিকানির্বাহ ও ব্রতাদি পালন করতেন। তিনি স্ত্রীপুত্রের সহিত পনর দিনে একদিন মাত্র খেতেন, প্রতি অমাবস্যা-পূর্ণিমায় যাগ করতেন এবং অতিথিদের এক দ্রোণ[২] ব্রীহির (তণ্ডুলের) অন্ন দিতেন। যে অন্ন অবশিষ্ট থাকত তা অতিথি দেখলেই বৃদ্ধি পেত। একদিন দুর্বাসা ঋষি মুণ্ডিতমস্তকে দিগম্বর হয়ে কটুবাক্য বলতে বলতে উন্মত্তের ন্যায় উপস্থিত হয়ে বললেন, আমাকে অন্ন দাও। মুদ্‌গল অন্ন দিলে দুর্বাসা সমস্ত ভোজন করলেন এবং গায়ে উচ্ছিষ্ট মেখে চ’লে গেলেন। এইরূপ পর পর ছবার পর্বদিনে এসে দুর্বাসা সমস্ত অন্ন খেয়ে গেলেন, মুদ্‌গল নির্বিকারমনে অনাহারে রইলেন। দুর্বাসা সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, তোমার মহৎ দানের সংবাদ স্বর্গে ঘোষিত হয়েছে, তুমি সশরীরে সেখানে যাবে।

 এই সময়ে এক দেবদূত বিচিত্র বিমান নিয়ে এসে মুদ্‌গলকে বললে, মুনি, আপনি পরমা সিদ্ধি লাভ করেছেন, এখন এই বিমানে উঠে স্বর্গে চলুন। মুদ্‌গল বললেন, স্বর্গবাসের গুণ আর দোষ কি আগে বল। দেবদূত বললে, যাঁরা ধর্মাত্মা জিতেন্দ্রিয় দানশীল, যাঁরা সম্মুখ সমরে নিহত, তাঁরাই স্বর্গবাসের অধিকারী। সেখানে ঈর্ষা শোক ক্লান্তি মোহ মাৎসর্য নেই। দেবগণ সাধ্যগণ মহর্ষিগণ প্রভৃতি সেখানে নিজ নিজ ধামে বাস করেন। তা ভিন্ন তেত্রিশ জন ঋভু আছেন, তাঁদের স্থান আরও উচ্চে, দেবতারাও তাঁদের পূজা করেন। আপনি দান ও তপস্যার প্রভাবে ঋভুগণের সম্পদ লাভ করেছেন। স্বর্গের গুণ আপনাকে বললাম, এখন দোষ শুনুন। স্বর্গে কৃতকর্মের ফলভোগ হয় কিন্তু নূতন কর্ম করা যায় না। সেখানে অপরের অধিকতর সম্পদ দেখে অসন্তোষ হয়, কর্মক্ষয় হ’লে আবার ধরাতলে পতন হয়।

 মুদ্‌গল বললেন, বৎস দেবদূত, নমস্কার, তুমি ফিরে যাও, স্বর্গসুখ আমি চাই না। যে অবস্থায় মানুষ শোকদুঃখ পায় না, পতিতও হয় না, আমি সেই কৈবল্যের অন্বেষণ করব। দেবদূত চ’লে গেলে মুদ্‌গল শুদ্ধ জ্ঞানযোগ অবলম্বন ক’রে ধ্যানপরায়ণ হলেন এবং নির্বাণমুক্তিরূপ সিদ্ধি লাভ করলেন।

 এই উপাখ্যান ব’লে এবং যুধিষ্ঠিরকে প্রবোধ দিয়ে ব্যাসদেব নিজের আশ্রমে প্রস্থান করলেন।

  1. শস্য কাটার পর ক্ষেত্রে যে শস্য প’ড়ে থাকে তাই সংগ্রহ করা।
  2. শস্যাদির মাপ বিশেষ।