পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৩৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৪৬
মহাভারত

হয়ে পড়বে। ধৃতরাষ্ট্র ক্রুদ্ধ হয়ে বারণ করলেও আমরা কৃষ্ণকে বন্ধন ক’রে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করব।

 দুর্যোধনাদির এই অভিসন্ধি বুঝতে পেরে সাত্যকি সভা থেকে বেরিয়ে কৃতবর্মাকে বললেন, শীঘ্র আমাদের সৈন্য ব্যূহবন্ধ কর এবং বর্ম ধারণ ক’রে তুমি এই সভার দ্বারদেশে থাক। তার পর সাত্যকি সভায় গিয়ে কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্র ও বিদুরকে দুর্যোধনাদির অভিসন্ধি জানিয়ে বললেন, বালক ও জড়বুদ্ধি যেমন বস্ত্রদ্বারা প্রজ্জ্বলিত অগ্নি আবরণ করতে চায়, এই মূর্খগণ সেইরূপে কৃষ্ণকে বন্ধন করতে চাচ্ছে। বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, মহারাজ, আপনার পুত্রেরা কালের কবলে পড়েছে, তারা বিগর্হিত অসাধ্য কর্ম করতে যাচ্ছে।

 কৃষ্ণ বললেন, রাজা, এরা যদি আমাকে সবলে বন্দী করতে চায় তবে আপনি অনুমতি দিন, এরা আমাকে বাঁধুক কিংবা আমিই এদের বাঁধি। আমি এদের সকলকে নিগৃহীত করে পাণ্ডবদের হাতে দিতে পারি, তাতে অনায়াসে তাঁদের কার্যসিদ্ধি হবে। কিন্তু আপনার সমক্ষে আমি এই নিন্দিত কর্ম করব না। আমি অনুমতি দিচ্ছি, দুর্যোধন যা ইচ্ছা হয় করুক।

 দুর্যোধনকে আবার ডেকে আনিয়ে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, নৃশংস পাপিষ্ঠ, তুমি ক্ষুদ্রবুদ্ধি পাপাত্মাদের সাহায্যে পাপকর্ম করতে চাচ্ছ! হস্ত দ্বারা বায়ুকে ধরা যায় না, চন্দ্রকেও স্পর্শ করা যায় না, মস্তকদ্বারা পৃথিবী ধারণ করা যায় না; সেইরূপ কৃষ্ণকেও সবলে গ্রহণ করা যায় না।

 কৃষ্ণ বললেন, দুর্যোধন, তুমি মোহবশে মনে করছ আমি একাকী, তাই আমাকে সবলে বন্দী করতে চাচ্ছ। এই দেখ—পাণ্ডবগণ, অন্ধক ও বৃষ্ণিবংশীয়গণ, আদিত্য রূদ্র ও বসুগণ, মহর্ষিগণ, সকলেই এখানে আছেন। এই ব’লে কৃষ্ণ উচ্চহাসা করলেন। তখন সহসা তাঁর ললাটে ব্রহ্মা, বক্ষে রুদ্র, মুখ থেকে অগ্নি, এবং অন্যান্য অঙ্গ থেকে ইন্দ্রাদি দেবতা যক্ষ রক্ষ গন্ধর্ব প্রভৃতি, হলধর বলরাম ও পঞ্চ পাণ্ডব আবির্ভূত হলেন। আয়ুধ উদ্যত ক’রে অন্ধক ও বৃষ্ণিবংশীয় বীরগণ তাঁর সম্মুখে এলেন এবং শঙ্খ চক্র গদা শক্তি শার্ঙ্গধনু সর্বপ্রকার প্রহরণও উপস্থিত হ’ল। সহস্রচরণ সহস্রবাহু সহস্রনয়ন কৃষ্ণের ঘোর মূর্তি দেখে সভাস্থ সকলে ভয়ে চোখ বুজলেন, কেবল ভীষ্ম দ্রোণ সঞ্জয় ও ঋষিরা চেয়ে রইলেন, কারণ ভগবান জনার্দন তাঁদের দিব্যচক্ষু দিয়েছিলেন। ধৃতরাষ্ট্রও দিব্যদৃষ্টি পেয়ে কৃষ্ণের পরম রূপ দেখলেন। দেবতা গন্ধর্ব ঋষি প্রভৃতি প্রণাম ক’রে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, প্রভু, প্রসন্ন হও, তোমার রূপ সংবরণ কর, নতুবা জগৎ বিনষ্ট হবে।