পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৪২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভীষ্মপর্ব
৩৯৯

সেই মহারথগণকে জয় করবার শক্তিও তাঁর নেই। অতএব তুমি শীঘ্র ভীষ্মের শিবিরে যাও, বৃদ্ধ পিতামহকে সম্মান দেখিয়ে তাঁকে অস্ত্রত্যাগে সম্মত করাও।

 দুর্যোধন অশ্বারোহণে ভীষ্মের শিবিরে চললেন, তাঁর ভ্রাতারাও সঙ্গে গেলেন। ভৃত্যগণ গন্ধতৈলযুক্ত প্রদীপ নিয়ে পথ দেখাতে লাগল। উষ্ণীষকঞ্চুকধারী রক্ষিগণ বেত্রহস্তে ধীরে ধীরে চারিদিকের জনতা সরিয়ে দিলে। ভীষ্মের কাছে গিয়ে দুর্যোধন কৃতাঞ্জলি হয়ে সাশ্রুনয়নে গদ্‌গদকণ্ঠে বললেন, শত্রুহন্তা পিতামহ, আমার উপর কৃপা করুন, ইন্দ্র যেমন দানবদের বধ করেছিলেন আপনি সেইরূপ পাণ্ডবগণকে বধ করুন। আপনার প্রতিজ্ঞা স্মরণ করুন, পাণ্ডব পাঞ্চাল কেকয় প্রভৃতিকে বধ ক’রে সত্যবাদী হ’ন। যদি আমার দুর্ভাগ্যক্রমে কৃপাবিষ্ট হয়ে বা আমার প্রতি বিদ্বেষের বশে আপনি পাণ্ডবদের রক্ষা করতেই চান, তবে কর্ণকে যুদ্ধ করবার অনুমতি দিন, তিনিই পাণ্ডবগণকে জয় করবেন।

 দূর্যোধনের বাক্‌শল্যে বিদ্ধ হয়ে মহামনা ভীষ্ম অত্যন্ত দুঃখিত ও ক্রুদ্ধ হলেন, কিন্তু কোনও অপ্রিয় বাক্য বললেন না। দীর্ঘকাল চিন্তার পর তিনি মৃদুবাক্যে বললেন, দুর্যোধন, আমাকে বাক্যবাণে পীড়িত করছ কেন, আমি যথাশক্তি চেষ্টা করছি, তোমার প্রিয়কামনায় সমরানলে প্রাণ আহুতি দিতে প্রস্তুত হয়েছি। পাণ্ডবগণ কিরূপ পরাক্রান্ত তার প্রচুর নিদর্শন তুমি পেয়েছ। খাণ্ডবদাহকালে অর্জুন ইন্দ্রকেও পরাস্ত করেছিলেন। তোমার বীর ভ্রাতারা আর কর্ণ যখন পালিয়েছিলেন তখন অর্জুন তোমাকে গন্ধর্বদের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। বিরাটনগরে গোহরণকালে একাকী অর্জুন আমাদের সকলকে জয় ক’রে উত্তরকে দিয়ে আমাদের বস্ত্র হরণ করিয়েছিলেন। শঙ্খচক্রগদাধর অনন্তশক্তি সর্বেশ্বর পরমাত্মা বাসুদেব যাঁর রক্ষক সেই অর্জুনকে যুদ্ধে কে জয় করতে পারে? নারদাদি মহর্ষিগণ বহুবার তোমাকে বলেছেন কিন্তু তুমি মোহবশে বুঝতে পার না, মুমূর্ষু লোক যেমন সকল বৃক্ষই কাঞ্চনময় দেখে তুমিও সেইরূপ বিপরীত দেখছ। তুমিই এই মহাবৈর সৃষ্টি করেছ, এখন নিজেই যুদ্ধে ক’রে পৌরুষ দেখাও। আমি সোমক পাঞ্চাল ও কেকয়গণকে বিনষ্ট করব, হয় তাদের হাতে ম’রে যমালয়ে যাব নতুবা তাদের সংহার করে তোমাকে তুষ্ট করব। কিন্তু আমার প্রাণ গেলেও শিখণ্ডীকে বধ করব না, কারণ বিধাতা তাকে পূর্বে শিখণ্ডিনী রূপেই সৃষ্টি করেছিলেন। গান্ধারীপুত্র, সুখে নিদ্রা যাও, কাল আমি এমন মহাযুদ্ধ করব যে লোকে চিরকাল তার কথা বলবে। ভীষ্মের কথা শুনে দুর্যোধন নতমস্তকে প্রণাম ক’রে নিজের শিবিরে চলে গেলেন। ভীষ্ম নিজেকে তিরস্কৃত মনে করলেন, তাঁর অতিশয় আত্মগ্লানি হল।