পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
আদিপর্ব
১৯

 সৌতি বললেন।—ভগবান শেষ নাগ (অনন্ত, বাসুকি) কদ্রুর জ্যেষ্ঠ পুত্র। ইনি মাতার অভিশাপের পর নানা পবিত্র তীর্থে গিয়ে কঠোর তপস্যা করতে লাগলেন। ব্রহ্মা তাঁর কাছে এসে বললেন, তোমার কি কামনা তা বল। শেষ উত্তর দিলেন, আমার সহোদরগণ অতি মন্দমতি, তারা আমার বৈমাত্র ভ্রাতা গরুড়কে দ্বেষ করে। আমি পরলোকেও সহোদরদের সংসর্গ চাই না, সেজন্য তপস্যায় প্রাণ বিসর্জন দেব। ব্রহ্মা বললেন, আমি তোমার ভ্রাতাদের আচরণ জানি। ভাগ্যক্রমে তোমার ধর্মবুদ্ধি হয়েছে, তুমি আমার আদেশে এই শৈল-বন-সাগর-জনপদাদি-সমন্বিত চঞ্চল পৃথিবীকে নিশ্চল ক’রে ধারণ কর। শেষ নাগ পাতালে গিয়ে মস্তক দ্বারা পৃথিবা ধারণ করলেন, ব্রহ্মার ইচ্ছায় গরুড় তাঁর সহায় হলেন। পাতালবাসী নাগগণ তাঁকে বাসুকিরূপে নাগরাজপদে অভিষিক্ত করলেন।

 মাতৃপ্রদত্ত শাপ খণ্ড করবার জন্য বাসুকি তাঁর ধার্মিক ভ্রাতাদের সঙ্গে মন্ত্রণা করলেন। নাগগণ অনেক প্রকার উপায় নির্দেশ করলেন কিন্তু বাসুকি কোনওটিতে সম্মত হলেন না। তখন এলাপত্র নামে এক নাগ বললেন, আমাদের মাতা যখন অভিশাপ দেন তখন আমি তাঁর ক্রোড়ে ব’সে শুনেছিলাম—ব্রহ্মা দেবগণকে বলছেন, তপস্বী পরিব্রাজক জরৎকারুর ঔরসে বাসুকির ভগিনী[১] জরৎকারুর গর্ভে আস্তীক নামে এক পুত্র জন্মগ্রহণ করবেন, তিনিই ধার্মিক সর্পগণকে রক্ষা করবেন।

 তারপর বাসুকি বহু অন্বেষণের পর মহর্ষি জরৎকারুকে পেয়ে তাঁকে ভগিনী সম্প্রদান করলেন। সেই ধার্মিক তপস্বী বাসুকির প্রদত্ত রমণীয় গৃহে সস্ত্রীক বাস করতে লাগলেন। তিনি ভার্যাকে বললেন, তুমি কদাচ আমার অপ্রিয় কিছু করবে না, যদি কর তবে এই বাসগৃহ আর তোমাকে ত্যাগ করব। বাসুকির ভগিনী তাতেই সম্মত হলেন এবং শ্বেতকাকী[২]র ন্যায় পতির সেবা করে যথাকালে গর্ভবতী হলেন। একদিন মহর্ষি তাঁর ক্রোড়ে মস্তক রেখে নিদ্রা যাচ্ছিলেন এমন সময় সূর্যাস্তকাল উপস্থিত হ’ল। পাছে সন্ধ্যাকৃত্যের কাল উত্তীর্ণ হয় এই আশঙ্কায় তিনি মৃদুস্বরে স্বামীকে জাগালেন। মহর্ষি বললেন, নিদ্রাভঙ্গ করে তুমি আমার অবমাননা করেছ, তোমার কাছে আর আমি থাকব না। আমি যতক্ষণ সুপ্ত থাকি ততক্ষণ সূর্যের অস্ত যাবার ক্ষমতা নেই। অনেক অনুনয় করলেও তিনি তাঁর বাক্য প্রত্যাহার করলেন না, যাবার সময় পত্নীকে ব’লে গেলেন, ভাগ্যবতী, তোমার গর্ভে অগ্নিতুল্য তেজস্বী পরম ধর্মাত্মা বেদজ্ঞ ঋষি আছেন।

  1. ইনিই মনসা দেবী।
  2. টীকাকার নীলকণ্ঠ অর্থ করেছেন স্ত্রী-বক।