পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
আদিপর্ব
২১

 পরীক্ষিৎ অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে মন্ত্রীদের সঙ্গে মন্ত্রণা করলেন। তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি একটিমাত্র স্তম্ভের উপর সুরক্ষিত প্রাসাদ নির্মাণ করালেন এবং বিষচিকিৎসক ও মন্ত্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণগণকে নিযুক্ত করলেন। তিনি সেখানে থেকেই মন্ত্রীদের সাহায্যে রাজকার্য করতে লাগলেন, অন্য কেউ তাঁর কাছে আসতে পারত না। সপ্তম দিনে কাশ্যপ নামে এক ব্রাহ্মণ বিষচিকিৎসার জন্য রাজার কাছে যাচ্ছিলেন। বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বেশে তক্ষক তাঁকে বললে, আপনি এত দ্রুত কোথায় যাচ্ছেন? কাশ্যপ বললেন, আজ তক্ষক নাগ পরীক্ষিৎকে দংশন করবে, আমি গুরুর কৃপায় বিষ নষ্ট করতে পারি, রাজাকে সদ্য সদ্য নিরাময় করব। তক্ষক বললে, আমিই তক্ষক, এই বটবৃক্ষে দংশন করছি, আপনার মন্ত্রবল দেখান।

 তক্ষকের দংশনে বটবৃক্ষ জ্ব’লে গেল। কাশ্যপের মন্ত্রশক্তিতে ভস্মরাশি থেকে প্রথমে অঙ্কুর, তারপর দুটি পল্লব, তারপর বহু পত্র ও শাখাপ্রশাখা উদ্ভূত হ’ল। তক্ষক বললে, তপোধন, আপনি কিসের প্রার্থী হয়ে রাজার কাছে যাচ্ছেন? ব্রাহ্মণের শাপে তাঁর আয়ু ক্ষয় পেয়েছে, আপনি তাঁর চিকিৎসায় কৃতকার্য হবেন কিনা সন্দেহ। রাজার কাছে আপনি যত ধন আশা করেন তার চেয়ে বেশী আমি দেব, আপনি ফিরে যান। কাশ্যপ ধ্যান ক’রে জানলেন যে পরীক্ষিতের আয়ু শেষ হয়েছে, তিনি তক্ষকের কাছে অভীষ্ট ধন নিয়ে চলে গেলেন।

 তক্ষকের উপদেশে কয়েকজন নাগ তপস্বী সেজে ফল কুশ আর জল নিয়ে পরীক্ষিতের কাছে গেল। রাজা সেই সকল উপহার নিয়ে তাদের বিদায় দিলেন এবং অমাত্য-সুহৃদ্‌গণের সঙ্গে ফল খাবার উপক্রম করলেন। তাঁর ফলে একটি ক্ষুদ্র কৃষ্ণনয়ন তাম্রবর্ণ কীট দেখে রাজা তা হাতে ধ’রে সচিবদের বললেন, সূর্য অস্ত যাচ্ছেন, আমার দুঃখ বা ভয় নেই, শৃঙ্গীর বাক্য সত্য হ’ক, এই কীট তক্ষক হয়ে আমাকে দংশন করুক। এই ব’লে তিনি নিজের কণ্ঠদেশে সেই কীট রেখে হাসতে লাগলেন। তখন কীটরূপী তক্ষক নিজ মূর্তি ধ’রে রাজাকে বেষ্টন করলে এবং সগর্জনে তাঁকে দংশন করলে। মন্ত্রীরা ভয়ে পালিয়ে গেলেন। তার পর তাঁরা দেখলেন, পদ্মবর্ণ তক্ষক আকাশে যেন সীমন্তরেখা বিস্তার ক’রে চলেছে। বিষের অনলে রাজার গৃহ আলোকিত হ’ল, তিনি বজ্রাহতের ন্যায় প’ড়ে গেলেন।

 পরীক্ষিতের মৃত্যুর পর রাজপুরোহিত এবং মন্ত্রীরা পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করে তাঁর শিশুপুত্র জনমেজয়কে রাজা করলেন। যথাকালে কাশীরাজ সুবর্ণবর্মার কন্যা বপুষ্টমার সঙ্গে জনমেজয়ের বিবাহ হ’ল। তিনি অন্য নারীর প্রতি মন দিতেন না, পতিব্রতা রূপবতী বপুষ্টমার সঙ্গে মহানন্দে কালযাপন করতে লাগলেন।