পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৪৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪৫৬
মহাভারত

গোবিন্দের কথা শুনুন, দ্রোণকে বলুন যে অশ্বত্থামা মরেছেন। আপনি বললে দ্রোণ আর যুদ্ধ করবেন না।

 কৃষ্ণের প্ররোচনায়, ভীমের সমর্থনে, এবং দ্রোণবধের ভবিতব্যতা জেনে যুধিষ্ঠির সম্মত হলেন। তাঁর অসত্যভাষণের ভয় ছিল, জয়লাভেরও আগ্রহ ছিল। তিনি উচ্চস্বরে বললেন, ‘অশ্বত্থামা হতঃ—অশ্বত্থামা হত হয়েছেন, তার পর অস্ফুটস্বরে বললেন, ‘ইতি কুঞ্জরঃ’—এই নামের হস্তী। যুধিষ্ঠিরের রথ পূর্বে ভূমি থেকে চার আঙুল উপরে থাকত, এখন মিথ্যা বলার পাপে তাঁর বাহনসকল ভূমি স্পর্শ করলে।

 মহর্ষিদের কথা শুনে দ্রোণের ধারণা জন্মেছিল যে তিনি পাণ্ডবদের নিকট অপরাধী হয়েছেন। এখন তিনি পুত্রের মৃত্যুসংবাদে শোকে অভিভূত এবং ধৃষ্টদ্যুম্নকে দেখে উদ্‌বিগ্ন হলেন, আর যুদ্ধ করতে পারলেন না। এই সময়ে ধৃষ্টদ্যুম্ন — যাঁকে দ্রুপদ প্রজ্বলিত অগ্নি থেকে দ্রোণবধের নিমিত্ত লাভ করেছিলেন—একটি সুদৃঢ় দীর্ঘ ধনুতে আশীবিষতুল্য শর সন্ধান করলেন। দ্রোণ সেই শর নিবারণের চেষ্টা করলেন, কিন্তু তার উপযুক্ত অস্ত্র তাঁর স্মরণ হ’ল না। দ্রোণের কাছে গিয়ে ভীম ধীরে ধীরে বললেন, যে হীন ব্রাহ্মণগণ স্বকর্মে তুষ্ট না থেকে অস্ত্রশিক্ষা করেছে, তারা যদি যুদ্ধে প্রবৃত্ত না হ’ত তবে ক্ষত্রিয়কুল ক্ষয় পেত না। এই সৈন্যরা নিজের বৃত্তি অনুসারে যুদ্ধ করছে, কিন্তু আপনি অব্রাহ্মণের বৃত্তি নিয়ে এক পুত্রের জন্য বহু প্রাণী বধ করছেন, আপনার লজ্জা হচ্ছে না কেন? যাঁর জন্য আপনি অস্ত্রধারণ ক’রে আছেন, যাঁর অপেক্ষায় আপনি জীবিত আছেন, সেই পুত্র আজ রণভূমিতে শুয়ে আছে। ধর্মরাজের বাক্যে আপনি সন্দেহ করতে পারেন না।

 দ্রোণ শরাসন ত্যাগ ক’রে বললেন, ‘কর্ণ, কর্ণ, কৃপ, দুর্যোধন, তোমরা যথাশক্তি যুদ্ধ কর, পাণ্ডবদের আর তোমাদের মঙ্গল হ’ক, আমি অস্ত্র ত্যাগ করলাম। এই ব’লে তিনি উচ্চস্বরে অশ্বত্থামাকে ডাকলেন, তার পর সমস্ত অস্ত্র রথের মধ্যে রেখে যোগস্থ হয়ে সর্বপ্রাণীকে অভয় দিলেন। এই অবসর পেয়ে ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁর রথ থেকে লাফিয়ে নামলেন এবং খড়্‌গ নিয়ে দ্রোণের প্রতি ধাবিত হলেন। দুই পক্ষের সৈন্যরা হাহাকার করে উঠল। দ্রোণ যোগমগ্ন হয়ে মুখ কিঞ্চিৎ উন্নত ক’রে নিমীলিতনেত্রে পরমপুরুষ বিষ্ণুকে ধ্যান করতে লাগলেন এবং ব্রহ্মস্বরূপ একাক্ষর ওম্-মন্ত্র স্মরণ করতে করতে ব্রহ্মলোকে যাত্রা করলেন। মৃত্যুকালে তাঁর দেহ থেকে দিব্য জ্যোতি নির্গত হয়ে উল্কার ন্যায় নিমেষমধ্যে