পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৪৮৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪৫৮
মহাভারত

মিথ্যাবাদী পাণ্ডব আচার্যকে অস্ত্রত্যাগ করিয়েছে, আজ রণভূমি সেই যুধিষ্ঠিরের রক্ত পান করবে। আমি এমন কর্ম করব যাতে পরলোকগত পিতার নিকট ঋণমুক্ত হ’তে পারি। আমার কাছে যে অস্ত্র আছে তা পাণ্ডবগণ কৃষ্ণ ধৃষ্টদ্যুম্ন শিখণ্ডী বা সাত্যকি কেউ জানেন না। আমার পিতা নারায়ণের পূজা ক’রে এই অস্ত্র পেয়েছিলেন। অস্ত্রদানকালে নারায়ণ বলেছিলেন, ব্রাহ্মণ, এই অস্ত্র সহসা প্রয়োগ করবে না। শত্রুসংহার না করে এই অস্ত্র নিবৃত্ত হয় না। এতে কে নিহত হবে না তা পূর্বে জানা যায় না, যারা অবধ্য তারাও নিহত হ’তে পারে। কিন্তু রথ ও অস্ত্র ত্যাগ করে শরণাগত হ’লে এই মহাস্ত্র থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। দুর্যোধন, আজ আমি সেই নারায়ণাস্ত্র দিয়ে পাণ্ডব পাঞ্চাল মৎস্য ও কেকয়গণকে বিদ্রাবিত করব। গুরুত্যাকারী পাপিষ্ঠ ধৃষ্টদ্যুম্ন আজ রক্ষা পাবে না।

 দ্রোণপুত্রের এই কথা শুনে কৌরবসৈন্য আশ্বস্ত হয়ে ফিরে এল, কৌরবশিবিরে শঙ্খ ও রণবাদ্য বাজতে লাগল। অশ্বত্থামা জলস্পর্শ করে নারায়ণাস্ত্র প্রকাশিত করলেন। তখন সগর্জনে বায়ু বইতে লাগল, পৃথিবী কম্পিত ও মহাসাগর বিক্ষুব্ধ হ’ল, নদীস্রোত বিপরীতগামী হ’ল, সূর্য মলিন হলেন।

 কৌরবশিবিরে তুমুল শব্দ শুনে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বললেন, দ্রোণাচার্যের নিধনের পর কৌরবরা হতাশ হয়ে রণস্থল থেকে পালিয়েছিল, এখন আবার ওদের ফিরিয়ে আনলে কে? ওদের মধ্যে ওই লোমহর্ষকর নিনাদ হচ্ছে কেন? অর্জুন বললেন, অশ্বত্থামা গর্জন করছেন। তিনি ভূমিষ্ঠ হয়েই উচ্চৈঃশ্রবার ন্যায় হ্রেষারব করেছিলেন সেজন্য তাঁর নাম অশ্বত্থামা। ধৃষ্টদ্যুম্ন আমার গুরুর কেশাকর্ষণ করেছিলেন, অশ্বত্থামা তা ক্ষমা করবেন না। মহারাজ, আপনি ধর্মজ্ঞ হয়েও রাজ্যলাভের জন্য মিথ্যা ব’লে মহাপাপ করেছেন। বালিবধের জন্য রামের যেমন অকীর্তি হয়েছে সেইরূপ দ্রোণবধের জন্য আপনার চিরস্থায়ী অকীর্তি হবে। এই পাণ্ডুপুত্র সর্বধর্মসম্পন্ন, এ আমার শিষ্য, এ মিথ্যা বলবে না — আপনার উপর দ্রোণের এই বিশ্বাস ছিল। আপনি অস্ত্রত্যাগী গুরুকে অধর্ম অনুসারে হত্যা করিয়েছেন, এখন যদি পারেন তো সকলে মিলে ধৃষ্টদ্যুম্নকে রক্ষা করুন। যিনি সর্বভূতে প্রীতিমান সেই অতিমানুষ অশ্বত্থামা পিতার কেশাকর্ষণ শুনে আজ আমাদের সংহার করবেন। আমাদের বয়সের অধিকাংশই অতীত হয়েছে, এখন যে অল্পকাল অবশিষ্ট আছে তা অধর্মাচরণের জন্য বিকারগ্রস্ত হ’ল। যিনি স্নেহের জন্য এবং ধর্মত পিতার তুল্য ছিলেন, অল্প কাল রাজ্যভোগের লোভে তাঁকে আমরা হত্যা করিয়েছি। হা, আমরা মহৎ পাপ করেছি!