পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৫২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
কর্ণপর্ব
৪৯৭

বধ করেছি, তাতেই তুমি নিঃশঙ্ক ও নিষ্ঠুর হয়েছ। অধিরাজের পদ পেয়ে তুমি যা করেছ তার আমি প্রশংসা করতে পারি না। তোমার দ্যূতাসক্তির জন্য আমাদের রাজ্যনাশ হয়েছে, আমরা বিপদে পড়েছি। তুমি অল্পভাগ্য, এখন ক্রূর বাক্যের কশাঘাতে আমাদের ক্রুদ্ধ ক’রো না।

 যুধিষ্ঠিরকে এইপ্রকার পরুষ বাক্য ব’লে অর্জুন অনুতপ্ত হলেন এবং নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে অসি কোষমুক্ত করলেন। কৃষ্ণ বললেন, একি, তুমি আবার অসি নিষ্কাশিত করলে কেন? অর্জুন বললেন, যে শরীরে আমি অহিত আচরণ করেছি সে শরীর আমি নষ্ট করব। কৃষ্ণ বললেন, রাজা যুধিষ্ঠিরকে ‘তুমি’ সম্বোধন করেছ সেজন্য মোহগ্রস্ত হ’লে কেন? তুমি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছ? যদি তুমি সত্যরক্ষার নিমিত্ত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে বধ করতে তবে তোমার কি অবস্থা হ’ত? পার্থ, ধর্মের তত্ত্ব সূক্ষ্ম ও দুর্জ্ঞেয়, বিশেষত অজ্ঞ লোকের কাছে। আমি যা বলছি শোন। আত্মহত্যা করলে তোমার ভ্রাতৃহত্যার চেয়ে গুরুতর পাপ হবে। এখন তুমি নিজের মুখে নিজের গুণকীর্তন কর, তাতেই আত্মহত্যা হবে।

 তখন ধনঞ্জয় তাঁর ধনু নমিত ক’রে যুধিষ্ঠিরকে বলতে লাগলেন, মহারাজ, শুনুন—পিনাকপাণি মহাদেব ভিন্ন আমার তুল্য ধনুর্ধর কেউ নেই। আমি মহাদেবের অনুমতিতে ক্ষণমধ্যে চরাচর সহ সমস্ত জগৎ বিনষ্ট করতে পারি। রাজসূয় যজ্ঞের পূর্বে আমিই সকল দিক ও দিক্‌পালগণকে জয় ক’রে আপনার বশে এনেছিলাম। আমার তেজেই আপনার দিব্য সভা নির্মিত এবং রাজসূয় যজ্ঞ সমাপ্ত হয়েছিল। আমার দক্ষিণ হস্তে বাণ, বাম হস্তে বাণযুক্ত বিস্তৃত ধনু, এবং দুই পদতলে রথ ও ধ্বজ অঙ্কিত আছে, আমার তুল্য পুরুষ যুদ্ধে অজেয়। সংশপ্তকদের অল্পই অবশিষ্ট আছে, শত্রু সৈন্যের অর্ধ ভাগ আমি বিনষ্ট করেছি। আমি অস্ত্র দ্বারাই অস্ত্রজ্ঞদের বধ করি, অশ্বপ্রয়োগে বিপক্ষ সৈন্য ভস্মসাৎ করি না। কৃষ্ণ, শীঘ্র চল, আমরা বিজয়রথে চড়ে সূতপত্রকে বধ করতে যাই। আমাদের রাজা আজ সুখলাভ করন, আমি কর্ণকে বিনষ্ট করব। আজ কর্ণের মাতা অথবা কুন্তী পুত্রহীনা হবেন, আমি সত্য বলছি — কর্ণকে বধ না ক’রে আমার কবচ খুলব না।

 এই কথা ব’লে অর্জুন তাঁর খড়্‌গ কোষবদ্ধ ক’রে ধনু ত্যাগ করলেন এবং লজ্জায় নতমস্তকে কৃতাঞ্জলিপুটে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, প্রসন্ন হ’ন, যা বলেছি তা ক্ষমা করুন, পরে আপনি আমার উদ্দেশ্য বুঝতে পারবেন, আপনাকে নমস্কার করছি। আমি ভীমকে যুদ্ধ থেকে মুক্ত করতে এবং সূতপত্রকে বধ করতে