পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৫২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
কর্ণপর্ব
৫০১

ন্যায় রথের মধ্যে শুয়ে পড়লেন এবং কিছুক্ষণ পরে সংজ্ঞালাভ ক’রে গর্জন ক’রে উঠলেন। দুঃশাসন ভীমসেনকে আবার শরাঘাতে নিপীড়িত করতে লাগলেন। ক্রোধে জ্ব’লে উঠে ভীম বললেন, দুরাত্মা, আজ যুদ্ধে তোমার রক্ত পান করব। দুঃশাসন মহাবেগে একটি শক্তি অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন, উগ্রমূর্তি ভীমও তাঁর ভীষণ গদা ঘূর্ণিত ক’রে প্রহার করলেন। গদার প্রহারে শক্তি ভগ্ন হ’ল, দুঃশাসন মস্তকে আহত হয়ে দশ ধনু (চল্লিশ হাত) দূরে নিক্ষিপ্ত হলেন, তাঁর অশ্ব ও রথও বিনষ্ট হ’ল।

 দুঃশাসন বেদনায় ছটফট করতে লাগলেন। তখন ভীমসেন নিরপরাধা রজস্বলা পতিকর্তৃক অরক্ষিতা দ্রৌপদীর কেশগ্রহণ বস্ত্রহরণ প্রভৃতি দুঃখ স্মরণ ক’রে ঘৃতসিক্ত হুতাশনের ন্যায় জ্ব’লে উঠলেন এবং কর্ণ দুর্যোধন কূপ অশ্বত্থামা ও কৃতবর্মাকে বললেন, ওহে যোদ্ধৃগণ, আজ আমি পাপী দুঃশাসনকে হত্যা করছি, পারেন তো একে রক্ষা করুন। এই ব’লে ভীম তাঁর রথ থেকে লাফিয়ে নামলেন। সিংহ যেমন মহাগজকে ধরে, বৃকোদর ভীম সেইরূপ কম্পমান দুঃশাসনকে আক্রমণ ক’রে গলায় পা দিয়ে চেপে ধরলেন, এবং তীক্ষ অসি দিয়ে তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ ক’রে ঈষদুষ্ণ রক্ত পান করলেন। তার পর ভূপতিত দুঃশাসনের শিরশ্ছেদ ক’রে রক্ত চাখতে চাখতে বললেন, মাতার স্তনদুগ্ধ, মধু, ঘৃত, উত্তম মাধ্বীক মদ্য, দিব্য জল এবং মথিত দুগ্ধ ও দধি প্রভৃতি অমৃততুল্য যত পানীয় আছে, সে সমস্তের চেয়ে এই শত্রুরক্ত অধিক সুস্বাদু মনে হচ্ছে। তার পর দুঃশাসনকে গতাসু দেখে উগ্রকর্মা ক্রোধাবিষ্ট ভীমসেন হাস্য ক’রে বললেন, আর আমি কি করতে পারি, মৃত্যু তোমাকে রক্ষা করেছে।

 রক্তপায়ী ভীমকে যারা দেখছিল তারা ভয়ে ব্যাকুল হয়ে ভূমিতে প’ড়ে গেল। তাদের হাত থেকে অস্ত্র খ’সে পড়ল, অস্ফুট আর্তনাদ করতে করতে অর্ধনিমীলিতনেত্রে তারা ভীমকে দেখতে লাগল। এ মানুষ নয়, রাক্ষস — এই ব’লে সৈন্যগণ ভয়ে পালিয়ে গেল। কর্ণভ্রাতা চিত্রসেনও পালাচ্ছিলেন, পাঞ্চালবীর যুধামন্যু তাঁকে শরাঘাতে বধ করলেন।

 উপস্থিত বীরগণের সমক্ষে দুঃশাসনের রক্তে অঞ্জলি পূর্ণ ক’রে ভীম সগর্জনে বললেন, পুরুষাধম, এই আমি তোমার কণ্ঠরুধির পান করছি, এখন আবার আমাকে ‘গরু গরু’ বল দেখি! দ্যূতসভায় আমাদের পরাজয়ের পর যারা ‘গরু গরু’ ব’লে নৃত্য করেছিল, এখন প্রতিনৃত্য ক’রে তাদেরই আমরা ‘গরু গরু’ বলব। তার পর রক্তাত্তদেহে মুখ থেকে রক্ত ক্ষরণ করতে করতে ঈষৎ হাস্য ক’রে ভীমসেন কৃষ্ণার্জুনকে বললেন, আমি দুঃশাসন সম্বন্ধে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তা আজ পূর্ণ