পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৫৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
কর্ণপর্ব
৫০৫

করেছিলে; ওই দেখ, আকাশচ্যুত প্রজ্জ্বলিত উল্কার ন্যায় তোমার দিকে আসছে। অর্জুন ছয় বাণের আঘাতে অশ্বসেনকে কেটে ভূপাতিত করলেন। তখন পুরুষোত্তম কৃষ্ণ স্বয়ং দুই হাতে টেনে অর্জুনের রথ ভূমি থেকে তুললেন।

 অর্জুন শরাঘাতে কর্ণের মণিভূষিত স্বর্ণকিরীট, কুণ্ডল ও উজ্জ্বল বর্ম বহু খণ্ডে ছেদন করলেন এবং বর্মহীন কর্ণকে ক্ষতবিক্ষত করলেন। বায়ু পিত্ত-কফ-জনিত জ্বরে আক্রান্ত রোগীর ন্যায় কর্ণ বেদনা ভোগ করতে লাগলেন। তার পর অর্জুন যমদণ্ডতুল্য লৌহময় বাণে তাঁর বক্ষস্থল বিদ্ধ করলেন। কর্ণের মুষ্টি শিথিল হ’ল, তিনি ধনুর্বাণ ত্যাগ করে অবশ হয়ে টলতে লাগলেন। সৎস্বভাব পুরুষশ্রেষ্ঠ অর্জুন সেই অবস্থায় কর্ণকে মারতে ইচ্ছা করলেন না। তখন কৃষ্ণ ব্যস্ত হয়ে বললেন, পাণ্ডুপুত্র, তুমি প্রমাদগ্রস্ত হচ্ছ কেন? বুদ্ধিমান লোকে দুর্বল বিপক্ষকে অবসর দেন না, বিপদগ্রস্ত শত্রুকে বধ ক’রে ধর্ম ও যশ লাভ করেন। তুমি ত্বরান্বিত হও, নতুবা কর্ণ সবল হয়ে আবার তোমাকে আক্রমণ করবেন। কৃষ্ণের উপদেশ অনুসারে অর্জুন শরাঘাতে কর্ণকে আচ্ছন্ন করলেন, কর্ণও প্রকৃতিস্থ হয়ে কৃষ্ণার্জুনকে শরবিদ্ধ করতে লাগলেন।

 কর্ণের মৃত্যু আসন্ন হওয়ায় কাল অদৃশ্যভাবে তাঁকে ব্রাহ্মণের শাপের বিষয় জানিয়ে বললেন, ভূমি তোমার রথচক্র গ্রাস করছে। তখন কর্ণ পরশুরামপ্রদত্ত ব্রাহ্ম মহাস্ত্রের বিষয় ভুলে গেলেন, তাঁর রথও ভূমিতে মগ্ন হয়ে ঘুরতে লাগল। কর্ণ বিষণ্ণ হয়ে দুই হাত নেড়ে বললেন, ধর্মজ্ঞগণ সর্বদাই বলেন যে ধর্ম ধার্মিককে রক্ষা করেন। আমরা যথাযোগ্য ধর্মাচরণ করি, কিন্তু দেখছি ধর্ম ভক্তগণকে রক্ষা না ক’রে বিনাশই করেন। তার পর কর্ণ অনবরত শরবর্ষণ ক’রে অর্জুনের ধনুর্গুণ বার বার ছেদন করতে লাগলেন। কৃষ্ণের উপদেশে অর্জুন এক ভয়ংকর লৌহময় দিব্যাস্ত্র মন্ত্রপাঠ ক’রে তাঁর ধনুতে যোজনা করলেন। এই সময়ে কর্ণের রথচক্র আরও ভূপ্রবিষ্ট হ’ল। ক্রোধে অশ্রুপাত ক’রে কর্ণ বললেন, পাণ্ডুপুত্র, মুহূর্তকাল অপেক্ষা কর, দৈবক্রমে আমার রথের বাম চক্র ভূমিতে ব’সে গেছে। তুমি কাপুরুষের অভিসন্ধি ত্যাগ কর, সাধুস্বভাব বীরগণ যাচমান বা দুর্দশাপন্ন বিপক্ষের প্রতি অশ্বক্ষেপণ করেন না। তোমাকে বা বাসুদেবকে আমি ভয় করি না, তুমি মহাকুলবিবর্ধন ক্ষত্রিয়পুত্র, ধর্মোপদেশ স্মরণ ক’রে ক্ষণকাল ক্ষমা কর।

 কৃষ্ণ বললেন, রাধেয়, অদৃষ্টের বশে এখন তুমি ধর্ম স্মরণ করছ। নীচ লোকে বিপদে পড়লে দৈবের নিন্দা করে, নিজের কুকর্মের নিন্দা করে না। তুমি যখন দুর্যোধন দুঃশাসন আর শকুনির সঙ্গে মিলে একবস্ত্রা দ্রৌপদীকে দ্যূতসভায়