পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৫৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫০৬
মহাভারত

আনিয়েছিলে তখন তোমার ধর্ম স্মরণ হয় নি। যখন অক্ষনিপুণ শকুনি অনভিজ্ঞ যুধিষ্ঠিরকে জয় করেছিলেন তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? যখন তোমার সম্মতিতে দুর্যোধন ভীমকে বিষযুক্ত খাদ্য দিয়েছিল, জতুগৃহে সুপ্ত পাণ্ডবদের যখন দগ্ধ করবার চেষ্টা করেছিল, দুঃশাসন কর্তৃক গৃহীতা রজস্বলা দ্রৌপদীকে যখন তুমি উপহাস করেছিলে, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? ত্রয়োদশ বর্ষ অতীত হ’লেও তোমরা যখন পাণ্ডবদের রাজ্য ফিরিয়ে দাও নি, বহু মহারথের সঙ্গে মিলে যখন বালক অভিমন্যুকে হত্যা করেছিলে, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? এই সব সময়ে যদি তোমার ধর্ম না থাকে তবে এখন ধর্ম ধর্ম ক’রে তালু শুখিয়ে লাভ কি? আজ তুমি যতই ধর্মাচরণ কর তথাপি নিষ্কৃতি পাবে না।

 বাসুদেবের কথা শুনে কর্ণ লজ্জায় অধোবদন হলেন, কোনও উত্তর দিলেন না। তিনি ক্রোধে ওষ্ঠ স্পন্দিত করে ধনু তুলে নিয়ে অর্জুনকে মারবার জন্য একটি ভয়ংকর বাণ যোজনা করলেন। মহাসর্প যেমন বল্মীকে প্রবেশ করে, কর্ণের বাণ সেইরূপ অর্জুনের বাহুমধ্যে প্রবেশ করলে। অর্জুনের মাথা ঘুরতে লাগল, দেহ কাঁপতে লাগল, হাত থেকে গাণ্ডীব প’ড়ে গেল। এই অবসরে কর্ণ রথ থেকে লাফিয়ে নেমে দুই হাত দিয়ে রথচক্র তোলবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। তখন অর্জুন সংজ্ঞালাভ ক’রে ক্ষুরপ্র বাণ দিয়ে কর্ণের রত্নভূষিত ধ্বজ এবং তার উপরিস্থ উজ্জ্বল হস্তিরজ্জুলাঞ্ছন কেটে ফেললেন। তার পর তিনি তূণ থেকে বজ্র অগ্নি ও যমদণ্ডের ন্যায় করাল অঞ্জলিক বাণ তুলে নিয়ে বললেন, যদি আমি তপস্যা ও যজ্ঞ ক’রে থাকি, গুরুজনকে সন্তুষ্ট করে থাকি, সুহৃদ্‌গণের বাক্য শুনে থাকি, তবে এই বাণ আমার শত্রুর প্রাণহরণ করুক।

 অপরাহ্ণকালে অর্জুন সেই অঞ্জলিক বাণ দ্বারা কর্ণের মস্তক ছেদন করলেন। রক্তবর্ণ সূর্য যেমন অস্তাচল থেকে পতিত হন, সেইরূপ সেনাপতি কর্ণের উত্তমাঙ্গ ভূমিতে পতিত হ’ল। সকলে দেখলে, কর্ণের নিপতিত দেহ থেকে একটি তেজ আকাশে উঠে সূর্যমণ্ডলে প্রবেশ করলে। কৃষ্ণ অর্জুন ও অন্যান্য পাণ্ডবগণ হৃষ্ট হয়ে শঙ্খধ্বনি করলেন, পাণ্ডবপক্ষীয় সৈন্যগণ সিংহনাদ ও তূর্যধ্বনি ক’রে বস্ত্র ও বাহু সঞ্চালন করতে লাগল। বীর কর্ণ শোণিতাক্তদেহে শরাচ্ছন্ন হয়ে ভূমিতে প’ড়ে আছেন দেখে মদ্ররাজ শল্য ধ্বজহীন রথ নিয়ে চ’লে গেলেন।