পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৫৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
শল্যপর্ব
৫১৭

হবে, এর জীবনে কোনও প্রয়োজন নেই। সাত্যকি তখন খরধার খড়্‌গ তুলে সঞ্জয়কে বধ করতে উদ্যত হলেন। সেই সময়ে মহাপ্রাজ্ঞ কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস উপস্থিত হয়ে বললেন, সঞ্জয়কে মুক্তি দাও, একে বধ করা কখনও উচিত নয়। সাত্যকি কৃতাঞ্জলি হয়ে ব্যাসদেবের আদেশ মেনে নিয়ে বললেন, সঞ্জয়, যাও, তোমার মঙ্গল হ’ক। বর্মহীন ও নিরস্ত্র সঞ্জয় মুক্তি পেয়ে সায়াহ্ণকালে রুধিরাক্তদেহে হস্তিনাপুরের দিকে প্রস্থান করলেন।

 রণস্থল থেকে এক ক্রোশ দূরে গিয়ে সঞ্জয় দেখলেন, দুর্যোধন ক্ষতবিক্ষতদেহে গদাহস্তে একাকী রয়েছেন। দুজনে অশ্রুপূর্ণনয়নে কাতরভাবে কিছুক্ষণ পরস্পরের দিকে চেয়ে রইলেন, তার পর সঞ্জয় তাঁর বন্ধন ও মুক্তির বিষয় জানালেন। ক্ষণকাল পরে দুর্যোধন প্রকৃতিস্থ হয়ে তাঁর ভ্রাতৃগণ ও সৈন্যদের বিষয় জিজ্ঞাসা করলেন। সঞ্জয় বললেন, আপনার সকল ভ্রাতাই নিহত হয়েছেন, সৈন্যও নষ্ট হয়েছে, কেবল তিন জন রথী (কৃপ, অশ্বত্থামা ও কৃতবর্মা) অবশিষ্ট আছেন; প্রস্থানকালে ব্যাসদেব আমাকে এই কথা বলেছেন। দুর্যোধন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সঞ্জয়কে স্পর্শ ক’রে বললেন, এই সংগ্রামে আমার পক্ষে তুমি ভিন্ন দ্বিতীয় কেউ জীবিত নেই, কিন্তু পাণ্ডবরা সহায়সম্পন্নই রয়েছে। সঞ্জয়, তুমি প্রজ্ঞাচক্ষু রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে বলবে, আপনার পুত্র দুর্যোধন দ্বৈপায়ন হ্রদে আশ্রয় নিয়েছে। আমার সুহৃৎ ভ্রাতা ও পুত্রেরা গত হয়েছে, রাজ্য পাণ্ডবরা নিয়েছে, এ অবস্থায় কে বেঁচে থাকে? তুমি আরও বলবে, আমি মহাযুদ্ধ থেকে মুক্ত হয়ে ক্ষতবিক্ষতদেহে এই হ্রদে সুপ্তের ন্যায় নিশ্চেষ্ট হয়ে জীবিত রয়েছি।

 এই কথা ব’লে রাজা দুর্যোধন দ্বৈপায়ন হ্রদের মধ্যে প্রবেশ করলেন এবং মায়া দ্বারা তার জল স্তম্ভিত ক’রে রইলেন। এই সময়ে কৃপাচার্য অশ্বত্থামা ও কৃতবর্মা রথারোহণে সেখানে উপস্থিত হলেন। সঞ্জয় সকল সংবাদ জানালে অশ্বত্থামা বললেন, হা ধিক, রাজা দুর্যোধন জানেন না যে আমরা জীবিত আছি এবং তাঁর সঙ্গে মিলিত হয়ে শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করতেও সমর্থ আছি। সেই তিন মহারথ বহুক্ষণ বিলাপ করলেন, তার পর পাণ্ডবদের দেখতে পেয়ে বেগে শিবিরে চ’লে গেলেন।


 সূর্যাস্ত হ’লে কৌরবশিবিরের সকলেই দুর্যোধনভ্রাতাদের বিনাশের সংবাদ পেয়ে অত্যন্ত ভীত হ’ল। দুর্যোধনের অমাত্যগণ এবং বেত্রধারী নারীরক্ষকগণ রাজভার্যাদের নিয়ে হস্তিনাপুরে যাত্রা করলেন। শয্যা আস্তরণ প্রভৃতিও পাঠানো হ’ল। অন্যান্য সকলে অশ্বতরীযুক্ত রথে চ’ড়ে নিজ নিজ পত্নী সহ প্রস্থান করলেন।