পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৫৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
শল্যপর্ব
৫১৯

দুর্যোধনকে বললেন, রাজা, পাণ্ডবরা আসছে, অনুমতি দাও আমরা এখন চ’লে যাই। তাঁরা বিদায় নিয়ে দূরে গিয়ে এক বটবৃক্ষের নীচে বসে দুর্যোধনের বিষয় ভাবতে লাগলেন।

 হ্রদের তীরে এসে যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে বললেন, দেখ, দুর্যোধন দৈবী মায়ায় জল স্তম্ভিত ক’রে ভিতরে রয়েছে, এখন মানুষ হ’তে তার ভয় নেই; কিন্তু এই শঠ আমার কাছ থেকে জীবিত অবস্থায় মুক্তি পাবে না। কৃষ্ণ বললেন, ভরতনন্দন, মায়ার দ্বারাই মায়াবীকে নষ্ট করতে হয়। আপনি কূট উপায়ে দুর্যোধনকে বধ করুন, এইরূপ উপায়েই দানবরাজ বলি বদ্ধ হয়েছিলেন এবং হিরণ্যকশিপু পুত্র রাবণ তারকাসুর সুন্দ-উপসন্দ প্রভৃতি নিহত হয়েছিলেন।

 যুধিষ্ঠির সহাস্যে জলস্থ দুর্যোধনকে বললেন, সুযোধন, ওঠ, আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ কর। তোমার দর্প আর মান কোথায় গেল? যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা সজ্জনের ধর্ম নয়, স্বর্গপ্রদও নয়। তুমি পুত্র ভ্রাতা ও পিতৃগণকে নিপাতিত দেখেও যুদ্ধ শেষ না ক’রে নিজে বাঁচতে চাও কেন? বৎস, তুমি আত্মীয় বয়স্য ও বান্ধবগণকে বিনষ্ট করিয়ে হ্রদের মধ্যে লুকিয়ে আছ কেন? দুর্বদ্ধি, তুমি বীর নও তথাপি মিথ্যা বীরত্বের অভিমান কর। ওঠ, ভয় ত্যাগ ক’রে যুদ্ধ কর; আমাদের পরাজিত ক’রে পৃথিবী শাসন কর, অথবা নিহত হয়ে ভূমিতে শয়ন কর।

 দুর্যোধন জলের মধ্যে থেকে উত্তর দিলেন, মহারাজ, প্রাণিগণ ভয়ে অভিভূত হয় তা বিচিত্র নয়, কিন্তু আমি প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আসি নি। আমার রথ নেই, তূণ নেই, আমার পার্শ্বরক্ষী সারথি নিহত হয়েছে, আমি সহায়হীন একাকী, অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে বিশ্রামের জন্য জলমধ্যে আশ্রয় নিয়েছি। কুন্তীপুত্র, আপনারা আশ্বস্ত হ’ন, আমি উঠে আপনাদের সকলের সঙ্গেই যুদ্ধ করব।

 যুধিষ্ঠির বললেন, সুযোধন, আমরা আশ্বস্তই আছি। বহুক্ষণ তোমার অন্বেষণ করেছি, এখন জল থেকে উঠে যুদ্ধ কর। দুর্যোধন বললেন, মহারাজ, যাঁদের জন্য কুরুরাজ্য আমার কাম্য, আমার সেই ভ্রাতারা সকলেই পরলোকে গেছেন; আমাদের ধনরত্নের ক্ষয় হয়েছে, ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠগণ নিহত হয়েছেন, আমি বিধবা নারীর তুল্য এই পৃথিবী ভোগ করতে ইচ্ছা করি না। তথাপি আমি পাণ্ডব ও পাঞ্চালদের উৎসাহ ভঙ্গ ক’রে আপনাকে জয় করবার আশা করি। কিন্তু পিতামহ ভীষ্মের পতন ও দ্রোণ-কর্ণের নিধনের পর আর যুদ্ধের প্রয়োজন দেখি না। আমার পক্ষের সকলেই বিনষ্ট হয়েছে, আমার আর রাজ্যের স্পৃহা নেই, আমি দুই খণ্ড মৃগচর্ম পরে বনে যাব। মহারাজ, আপনি এই রিক্ত পৃথিবী যথাসুখে ভোগ করুন।