পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৫৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৪৪
মহাভারত

ভয়ে এবং পাণ্ডবদের বধের নিমিত্ত এই অস্ত্র নিক্ষেপ করেছি, আমি ক্রোধের বশে পাপকার্য করেছি; কিন্তু এই অস্ত্র প্রতিসংহারের শক্তি আমার নেই। ব্যাসদেব বললেন, বৎস, অর্জুন তোমাকে মারবার জন্য ব্রহ্মশির অস্ত্র প্রয়োগ করেন নি, তোমার অস্ত্র নিবারণের জন্যই করেছিলেন। পাণ্ডবগণ ও তাঁদের রাজ্য সর্বদাই তোমার রক্ষণীয়, আত্মরক্ষা করাও তোমার কর্তব্য। তোমার মস্তকের মণি পাণ্ডবদের দান কর, তা হ’লে তাঁরা তোমার প্রাণ দান করবেন।

 অশ্বত্থামা বললেন, ভগবান, পাণ্ডব আর কৌরবদের যত রত্ন আছে সে সমস্তের চেয়ে আমার মণির মূল্য অধিক, ধারণ করলে সকল ভয় নিবারিত হয়। আপনার আজ্ঞা আমার অবশ্য পালনীয়, কিন্তু ব্রহ্মশির অস্ত্রের প্রত্যাহার আমার অসাধ্য, অতএব তা পাণ্ডবনারীদের গর্ভে নিক্ষেপ করব। ব্যাসদেব বললেন, তাই কর।

 কৃষ্ণ বললেন, এক ব্রতপরায়ণ ব্রাহ্মণ অর্জুনের পুত্রবধূ উত্তরাকে বলেছিলেন, কুরুবংশ ক্ষয় পেলে পরীক্ষিৎ নামে তোমার একটি পুত্র হবে। সেই সাধু ব্রাহ্মণের বাক্য সফল হবে। অশ্বত্থামা ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, কেশব, তুমি পক্ষপাত ক’রে যা বলছ তা সত্য হবে না, আমার বাক্যের অন্যথা হবে না। কৃষ্ণ বললেন, তোমার মহাস্ত্র অব্যর্থ হবে, উত্তরার গর্ভস্থ শিশুও মরবে, কিন্তু সে আবার জীবিত হয়ে দীর্ঘায়ু পাবে। অশ্বত্থামা, তুমি কাপুরুষ, বহু পাপ করেছ, বালকবধে উদ্যত হয়েছ; অতএব পাপকর্মের ফলভোগ কর। তুমি তিন সহস্র বৎসর জনহীন দেশে অসহায় ব্যাধিগ্রস্ত ও শোণিতগন্ধী হয়ে বিচরণ করবে। নরাধম, তোমার অস্ত্রাগ্নিতে উত্তরার পুত্র দগ্ধ হ’লে আমি তাকে জীবিত করব, সে কৃপাচার্যের নিকট অস্ত্রশিক্ষা ক’রে ষাট বৎসর কুরুরাজ্য পালন করবে।

 অশ্বত্থামা ব্যাসদেবকে বললেন, ভগবান, পুরুষোত্তম কৃষ্ণের বাক্য সত্য হ’ক, আমি আপনার কাছেই থাকব। তার পর অশ্বত্থামা পাণ্ডবগণকে মণি দিয়ে বনগমন করলেন। কৃষ্ণ ও যুধিষ্ঠিরাদি ফিরে এলে ভীমসেন দ্রৌপদীকে বললেন, এই তোমার মণি নাও, তোমার পুত্রহন্তা পরাজিত হয়েছে, এখন শোক ত্যাগ কর। কৃষ্ণ যখন সন্ধিকামনায় হস্তিনাপুরে যাচ্ছিলেন তখন তুমি এই তীব্র বাক্য বলেছিলে — ‘গোবিন্দ, আমার পতি নেই পুত্র নেই ভ্রাতা নেই, তুমিও নেই।’ সেই কথা এখন স্মরণ কর। আমি পাপী দুর্যোধনকে বধ করেছি, দুঃশাসনের রক্ত পান করেছি; অশ্বত্থামাকেও জয় করেছি, কেবল ব্রাহ্মণ আর গুরুপুত্র ব’লে ছেড়ে দিয়েছি। তার যশ মণি এবং অস্ত্র নষ্ট হয়েছে, কেবল শরীর অবশিষ্ট আছে।