পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৫৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
শান্তিপর্ব
৫৫৫

দেবতুল্য, এঁদের প্রত্যেকেই আমাকে সুখী করতে পারেন। পঞ্চেন্দ্রিয় যেমন মিলিত হয়ে শরীরের ক্রিয়া সম্পাদন করে সেইরূপ আমার পঞ্চ পতি কি আমাকে সুখী করতে পারেন না? ধর্মরাজ, তুমি উন্মত্ত হয়েছ, তোমার ভ্রাতারাও যদি উন্মত্ত না হতেন তবে তোমাকে বেঁধে রেখে রাজ্যশাসন করতেন। নৃপশ্রেষ্ঠ, ব্যাকুল হয়ো না, পৃথিবী শাসন কর, ধর্মানুসারে প্রজাপালন কর।

 অর্জুন পুনর্বার বললেন, মহারাজ, রাজদণ্ডই প্রজা শাসন করে, ধর্ম অর্থ কাম এই ত্রিবর্গকে দণ্ডই রক্ষা করে। রাজার শাসন না থাকলে লোক বিনষ্ট হয়। ধর্মত বা অধর্মত যে উপায়েই হ’ক আপনি এই রাজ্য লাভ করেছেন, এখন শোক ত্যাগ ক’রে ভোগ করুন, যজ্ঞ ও দান করুন, প্রজাপালন ও শত্রুনাশ করুন।

 ভীম বললেন, আপনি সর্বশাস্ত্রজ্ঞ নরপতি, কাপপুরুষের ন্যায় মোহগ্রস্ত হচ্ছেন কেন? আপনি শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ ক’রে জয়ী হয়েছেন, এখন নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করুন। পিতৃপিতামহের অনুসরণ ক’রে রাজ্যশাসন ও অশ্বমেধ যজ্ঞ করুন, আমরা এবং বাসুদেব আপনার কিংকর রয়েছি।

 যুধিষ্ঠির বললেন, ভীম, অজ্ঞ লোকে নিজের উদরের জন্যই প্রাণিহিংসা করে, অতএব সেই উদরকে জয় কর, অল্পাহারে উদরাগ্নি প্রশমিত কর। রাজারা কিছুতেই সন্তুষ্ট হন না, কিন্তু সন্ন্যাসী অল্পে তুষ্ট হন। অর্জুন, দুইপ্রকার বেদবচন আছে — কর্ম কর, কর্ম ত্যাগ কর। তুমি যুদ্ধশাস্ত্রই জান, ধর্মের সূক্ষ্ম তত্ত্বে প্রবেশ করতে পারবে না। মোক্ষার্থিগণ সন্ন্যাস দ্বারাই পরমগতি লাভ করেন।

 মহাতপা মহর্ষি দেবস্থান ও ব্যাসদেব বহু উপদেশ দিলেন, কিন্তু যুধিষ্ঠিরের মন শান্ত হ’ল না। তিনি বললেন, বাল্যকালে যাঁর ক্রোড়ে আমি খেলা করেছি সেই ভীষ্ম আমার জন্য নিপাতিত হয়েছেন, আমার মিথ্যা কথার ফলে আচার্য দ্রোণ বিনষ্ট হয়েছেন, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কর্ণকেও আমি নিহত করিয়েছি, আমার রাজ্যলোভের জন্যই বালক অভিমন্যু প্রাণ দিয়েছে, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র বিনষ্ট হয়েছে। আমি পৃথিবীনাশক পাপী, আমি ভোজন করব না, পান করব না, প্রায়োপবেশনে শরীর শুষ্ক করব। তপোধনগণ, আপনারা অনুমতি দিন, আমি এই কলেবর ত্যাগ করব।

 অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, মাধব, ধর্মপুত্র শোকার্ণবে মগ্ন হয়েছেন, তুমি এঁকে আশ্বাস দাও। যুধিষ্ঠিরের চন্দনচর্চিত পাষাণতুল্য বাহু ধারণ ক’রে কৃষ্ণ বললেন, পুরুষশ্রেষ্ঠ, শোক সংবরণ করুন, যাঁরা যুদ্ধে মরেছেন তাঁদের আর ফিরে পাবেন না। সেই বীরগণ অস্ত্রপ্রহারে পূত হয়ে স্বর্গে গেছেন, তাঁদের জন্য শোক