পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৫৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৬০
মহাভারত

তোমার বাক্যে নিহিত আছে। দুর্বলতার ফলে আমার বাক্‌শক্তি ক্ষীণ হয়েছে, দিক আকাশ ও পৃথিবীর বোধও লোপ পেয়েছে, কেবল তোমার প্রভাবেই জীবিত রয়েছি। কৃষ্ণ, তুমি শাশ্বত জগৎকর্তা, গুরু উপস্থিত থাকতে শিষ্যতুল্য আমি কি ক’রে উপদেশ দেব?

 কৃষ্ণ বললেন, গঙ্গানন্দন ভীষ্ম, আমার বরে আপনার গ্লানি মোহ কষ্ট ক্ষুৎপিপাসা কিছুই থাকবে না, সমস্ত জ্ঞান আপনার নিকট প্রকাশিত হবে, ধর্ম ও অর্থের তত্ত্ব সম্বন্ধে আপনার বুদ্ধি তীক্ষ্ণ হবে, আপনি জ্ঞানচক্ষু দ্বারা সর্ব জীবই দেখতে পাবেন। কৃষ্ণ এই কথা বললে আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি হ’ল, বিবিধ বাদ্য বেজে উঠল, অপ্সরারা গান করতে লাগল, সুখস্পর্শ সুগন্ধ বায়ু, প্রবাহিত হ’ল। এই সময়ে পশ্চিম দিকের এক প্রান্তে অস্তগামী দিবাকর যেন বন দগ্ধ করতে লাগলেন। সন্ধ্যা সমাগত দেখে মহর্ষিগণ গাত্রোত্থান করলেন, কৃষ্ণ ও যুধিষ্ঠিরাদিও ভীষ্মের নিকট বিদায় নিয়ে প্রস্থান করলেন।

৫। রাজধর্ম

 পরদিন কৃষ্ণ, যুধিষ্ঠিরাদি ও সাত্যকি পুনর্বার ভীষ্মের নিকট উপস্থিত হলেন। নারদপ্রমুখ মহর্ষিগণ এবং ধৃতরাষ্ট্রও সেখানে এলেন। কৃষ্ণ কুশলপ্রশ্ন করলে ভীষ্ম বললেন, জনার্দন, তোমার প্রসাদে আমার সন্তাপ মোহ ক্লান্তি গ্লানি সবই দূর হয়েছে, ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান সমস্তই আমি করতলস্থ ফলের ন্যায় প্রত্যক্ষ দেখছি, সর্বপ্রকার ধর্ম আমার মনে পড়ছে, শ্রেয়স্কর বিষয় বলবার শক্তিও আমি পেয়েছি। এখন ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির আমাকে ধর্ম সম্বন্ধে প্রশ্ন করুন।

 কৃষ্ণ বললেন, পূজনীয় গুরুজন ও আত্মীয়-বান্ধব বিনষ্ট ক’রে ধর্মরাজ লজ্জিত হয়েছেন, অভিশাপের ভয়ে ইনি আপনার সম্মুখে আসতে পারছেন না। ভীষ্ম বললেন, পিতা পিতামহ ভ্রাতা গুরু আত্মীয় এবং বান্ধবগণ যদি অন্যায়যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন তবে তাঁদের বধ করলে ধর্মই হয়। তখন যুধিষ্ঠির সম্মুখে গিয়ে ভীষ্মের চরণ ধারণ করলেন। ভীষ্ম আশীর্বাদ ক’রে বললেন, বৎস, উপবিষ্ট হও, তুমি নির্ভয়ে আমাকে প্রশ্ন কর। যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, ধর্মজ্ঞরা বলেন যে নৃপতির পক্ষে রাজধর্মই শ্রেষ্ঠ ধর্ম; এই ধর্ম জীবলোকের অবলম্বন। রশ্মি যেমন অশ্বকে, অঙ্কুশ যেমন হস্তীকে, সেইরূপ রাজধর্ম সকল লোককে নিয়ন্ত্রিত করে। অতএব আপনি এই ধর্ম সম্বন্ধে বলুন।