পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৫৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
শান্তিপর্ব
৫৬১

 ভীষ্ম বললেন, মহান ধর্ম, বিধাতা কৃষ্ণ ও ব্রাহ্মণগণকে নমস্কার ক’রে আমি শাশ্বত ধর্ম বিবৃত করছি। কুরুশ্রেষ্ঠ, দেবতা ও দ্বিজগণের প্রীতিসম্পাদনের জন্য রাজা শাস্ত্রবিধি অনুসারে সকল কর্ম করবেন। বৎস যুধিষ্ঠির, তুমি সর্বদা উদ্‌যোগী হয়ে কর্ম করবে, পুরুষকার ভিন্ন কেবল দৈবে রাজকার্য সিদ্ধ হয় না। তুমি সকল কার্যই সরলভাবে করবে, কিন্তু নিজের ছিদ্রগোপন, পরের ছিদ্রান্বেষণ, এবং মন্ত্রণাগোপন বিষয়ে সরল হবে না। ব্রাহ্মণকে শারীরিক দণ্ড দেবে না, গুরুতর অপরাধ করলে রাজ্য থেকে নির্বাসিত করবে। শাস্ত্রে ছয় প্রকার দুর্গ উক্ত হয়েছে, তার মধ্যে নরদুর্গই সর্বাপেক্ষা দুর্ভেদ্য; অতএব প্রজাগণের প্রতি সদয় ব্যবহার করবে যাতে তারা অনুরক্ত থাকে। রাজা সর্বদা মৃদু হবেন না, সর্বদা কঠোরও হবেন না, বসন্তকালীন সূর্যের ন্যায় নাতিশীতোষ্ণ হবেন। গর্ভিণী যেমন নিজের প্রিয় বিষয় ত্যাগ ক’রে গর্ভেরই হিতসাধন করে, রাজাও সেইরূপ নিজের হিতচিন্তা না ক’রে প্রজারই হিতসাধন করবেন। ভৃত্যের সঙ্গে অধিক পরিহাস করবে না; তাতে তারা প্রভুকে অবজ্ঞা করে, তিরস্কার করে, উৎকোচ নিয়ে এবং বঞ্চনার দ্বারা রাজকার্য নষ্ট করে, প্রতিরূপকের (জাল শাসনপত্রাদির) সাহায্যে রাজ্যকে জীর্ণ করে। তারা বেতনে সন্তুষ্ট থাকে না, রাজার অর্থ হরণ করে, লোককে ব’লে বেড়ায়, ‘আমরাই রাজাকে চালাচ্ছি।’

 যুধিষ্ঠির, রাজ্যের সাতটি অঙ্গ আছে—অমাত্য সুহৃৎ কোষ রাষ্ট্র দুর্গ ও সৈন্য। যে তার বিরুদ্ধাচরণ করবে, গুরু বা মিত্র হ’লেও তাকে বধ করতে হবে। রাজা কাকেও অত্যন্ত অবিশ্বাস বা অত্যন্ত বিশ্বাস করবেন না। তিনি সাধু লোকের ধন হরণ করবেন না, অসাধুরই ধন নেবেন এবং সাধু লোককে দান করবেন। যাঁর রাজ্যে প্রজাগণ পিতার গৃহে পুত্রের ন্যায় নির্ভয়ে বিচরণ করে সেই রাজাই শ্রেষ্ঠ। শুত্রুাচার্য তাঁর রামচরিত আখ্যানে এই শ্লোকটি বলেছেন —

রাজানং প্রথমং বিন্দেৎ ততো ভার্যাং ততো ধনম্।
রাজন্যসতি লোকস্য কুতো ভার্যা কুতো ধনম্॥

—প্রথমেই কোনও রাজার আশ্রয় নেবে, তার পর ভার্যা আনবে, তার পর ধন আহরণ করবে; রাজা না থাকলে ভার্যা কি ক’রে ধনই বা কি ক’রে থাকবে?

 ভীষ্মের উপদেশ শুনে ব্যাসদেব কৃষ্ণ কৃপ সাত্যকি প্রভৃতি আনন্দিত হয়ে সাধু সাধু বললেন। যুধিষ্ঠির সজলনয়নে ভীষ্মের পাদস্পর্শ ক’রে বললেন, পিতামহ, সূর্য অস্ত যাচ্ছেন, কাল আবার আপনার কাছে আসব।