পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৬০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৭৪
মহাভারত

 যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, কিপ্রকার লোক সাধু? কার সঙ্গে পরম প্রীতি হয়? বর্তমান কালে এবং ভবিষ্যতে কারা হিতকারী হয়? আমার মনে হয়, হিতবাক্য শোনে এবং হিতকার্য করে এমন সুহৃৎ দুর্লভ। ভীষ্ম বললেন, যারা লোভী ক্রূর ধর্মত্যাগী শঠ অলস কুটিল গুরু পত্নীধর্ষক বন্ধুপরিত্যাগী নির্লজ্জ নাস্তিক অসত্যভাষী দুঃশীল নৃশংস, যে মিত্রের অপকার করে, অপরের অর্থ কামনা করে, অকারণে ক্রোধ এবং হঠাৎ বিরোধ করে, যারা সুরাপায়ী প্রাণিহিংসাপরায়ণ কৃতঘ্ন এবং জনসমাজে নিন্দিত, এমন লোকের সঙ্গে মিত্রতা করা উচিত নয়। যাঁরা সৎকুলজাত জ্ঞানী রূপবান গুণবান অলোভী কৃতজ্ঞ সত্যসন্ধ জিতেন্দ্রিয় ও জনসমাজ খ্যাত, তাঁরাই রাজার মিত্র হবার যোগ্য। যাঁরা কষ্টস্বীকার ক’রেও সুহৃদের কার্য করেন, তাঁরাই বিশ্বস্ত ও ধার্মিক হন এবং সহৃদ্‌গণের প্রতি সর্বদা অনুরক্ত থাকেন। কৃতঘ্ন ও মিত্রঘাতক নরাধমগণ সকলেরই বর্জনীয়। আমি এক প্রাচীন ইতিহাস বলছি শোন। —

 গৌতম নামে এক ব্রাহ্মণ ভিক্ষার জন্য এক ভদ্রস্বভাব দস্যুর গৃহে এসেছিলেন। দস্যু তাঁকে নূতন বস্ত্র এবং একটি বিধবা যুবতী দান করলে। গৌতম দস্যুদের আশ্রয়ে বাস করতে লাগলেন এবং তাদেরই তুল্য হিংস্র ও নির্দয় হলেন। কিছুকাল পরে এক শুদ্ধস্বভাব বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ সেই দস্যু গ্রামে এলেন; ইনি গৌতমের স্বদেশবাসী ও সখা ছিলেন। গৌতমের স্কন্ধে নিহত হংসের ভার, হস্তে ধনুর্বাণ এবং তাঁর রাক্ষসের ন্যায় রুধিরাক্ত দেহ দেখে নবাগত ব্রাহ্মণ বললেন, তুমি প্রসিদ্ধ বেদজ্ঞ বিপ্রের বংশে জন্মগ্রহণ ক’রে এমন কুলাঙ্গার হয়েছ কেন? গৌতম বললেন, আমি দরিদ্র ও বেদজ্ঞানশূন্য, অভাবে প’ড়ে এমন হয়েছি। আজ তুমি এখানে থাক, কাল আমি তোমার সঙ্গে চ’লে যাব। দয়ালু ব্রাহ্মণ সম্মত হয়ে সেখানে রাত্রিযাপন করলেন, কিন্তু গৌতম বার বার অনুরোধ করলেও আহার করলেন না।

 পরদিন ব্রাহ্মণ চ’লে গেলে গৌতমও সাগরের দিকে যাত্রা করলেন। তিনি একদল বণিকের সঙ্গ নিলেন, কিন্তু বন্য হস্তীর আক্রমণে বহু বণিক বিনষ্ট হ’ল, গৌতম একাকীই অরণ্যপথে যেতে লাগলেন এবং এক সুরম্য সমতল প্রদেশে উপস্থিত হলেন। সেখানে এক বৃহৎ বটবৃক্ষ দেখে গৌতম তার পাদদেশে সুখে নিদ্রা গেলেন। সন্ধ্যাকালে সেখানে ব্রহ্মার প্রিয় সখা কশ্যপপুত্র পক্ষিশ্রেষ্ঠ নাড়ীজঙ্ঘ নামক বকরাজ ব্রহ্মলোক থেকে অবতীর্ণ হলেন। ইনি ধরাতলে রাজধর্মা নামে বিখ্যাত ছিলেন।