পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৬০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
শান্তিপর্ব
৫৭৭

 ভীষ্ম বললেন, ধর্মের নানা দ্বার আছে, ধর্মকার্য কখনও বিফল হয় না। লোকের যে বিষয়ে নিষ্ঠা হয় তাকেই শ্রেয় জ্ঞান করে, অন্য বিষয়ে তার প্রবৃত্তি হয় না। সংসার অসার এই জ্ঞান হ’লে বৈরাগ্যের উদয় হয়, তখন বুদ্ধিমান লোকের আত্মমোক্ষের জন্য যত্ন করা উচিত। শোকনিবারণের উপায় আত্মজ্ঞান লাভ। আমি এক প্রাচীন কথা বলছি শোন। —

 রাজা সেনজিৎ পুত্রের মৃত্যুতে অত্যন্ত কাতর হয়েছিলেন। এক ব্রাহ্মণ তাঁকে এই কথা বলে প্রবোধ দিয়েছিলেন। — রাজা, তুমি নিজেই শোচনীয়, তবে অন্যের জন্য শোক করছ কেন? আমি মনে করি, আমার আত্মাও আমার নয়, আবার সমগ্র পৃথিবীই আমার। এইরূপ বুদ্ধি থাকায় আমি হৃষ্ট হই না ব্যথিতও হই না। মহাসাগরে যেসকল কাষ্ঠ ভাসে তারা কখনও মিলিত হয় কখনও পৃথক হয়; জীবগণের মিলনবিচ্ছেদও সেইরূপ। পুত্রাদির উপর স্নেহ করা উচিত নয়, কারণ বিচ্ছেদ অনিবার্য। তোমার পুত্র অদৃশ্য স্থান থেকে এসেছিল, আবার অদৃশ্য স্থানেই চ’লে গেছে; সে তোমাকে জানত না, তুমিও তাকে জানতে না, তবে কেন শোক করছ? বিষয়বাসনা থেকেই দুঃখের উৎপত্তি হয়। সুখের অন্তে দুঃখ এবং দুঃখের অন্তে সুখ হয়, সুখদুঃখ চক্রের ন্যায় আবর্তন করে। জীবন ও শরীর একসঙ্গেই উৎপন্ন হয়, একসঙ্গেই বিনষ্ট হয়। তৈলকার যেমন তৈলযন্ত্রে তিল নিপীড়িত করে, অজ্ঞানসম্ভুত ক্লেশসকল সেইরূপ জীবগণকে সংসারচক্রে নিপীড়িত করে। মানুষ স্ত্রীপুত্রাদির জন্য পাপকর্ম করে, কিন্তু সে একাকীই ইহলোকে ও পরলোকে পাপের ফল ভোগ করে। বুদ্ধি থাকলেই ধন হয় না, ধন থাকলেই সুখ হয় না। —

যে চ মূঢ়তমা লোকে যে চ বুদ্ধেঃ পরং গতাঃ।
তে নরাঃ সুখমেধন্তে ক্লিশ্যত্যন্তরিতো জনঃ ॥
যে চ বুদ্ধিসুখং প্রাপ্তা দ্বন্দ্বাতীতা বিমৎসরাঃ।
তান্নৈবার্থা ন চানর্থা ব্যথয়ন্তি কদাচন॥
অথ যে বুদ্ধিমপ্রাপ্তা ব্যতিক্রান্তাশ্চ মূঢ়তাম্।
তেঽতিবেলং প্রহৃষ্যন্তি সন্তাপমুপযান্তি চ॥
সুখং বা যদি বা দুঃখং প্রিয়ং বা যদি বাপ্রিয়ম্।
প্রাপ্তং প্রাপ্তমুপাসীত হৃদয়েনাপরাজিতঃ॥

— জগতে যারা মূঢ়তম এবং যারা পরমবুদ্ধি লাভ করেছে তারাই সুখভোগ করে, যারা মধ্যবর্তী তারা ক্লেশ পায়। যাঁরা রাগদ্বেষাদির অতীত এবং অসূয়াশূন্য হয়ে