পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৬০৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৭৮
মহাভারত

পরমবুদ্ধিজনিত সুখ লাভ করেছেন, অর্থ ও অনর্থ (ইষ্ট ও অনিষ্ট) তাঁদের কদাচ ব্যথিত করে না। আর যাঁরা পরমবুদ্ধি লাভ করেন নি অথচ মূঢ়তা অতিক্রম করেছেন, তাঁরাই অত্যন্ত হর্ষ ও অত্যন্ত সন্তাপ ভোগ করেন। সুখ বা দুঃখ, প্রিয় বা অপ্রিয়, যাই উপস্থিত হ’ক, অপরাজিত (অনভিভূত) হয়ে হৃদয়ে মেনে নেবে।

 ব্রাহ্মণের নিকট এইপ্রকার উপদেশ পেয়ে সেনজিৎ শান্তিলাভ করলেন।

১৬। অজগরব্রত—কামনাত্যাগ

 ভীষ্ম বললেন, শম্পাক নামে এক ব্রাহ্মণ তাঁর পত্নীর আচরণে এবং অন্নবস্ত্রের অভাবে কষ্ট পেয়ে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, মানুষ জন্মাবধি যে সুখদুঃখ ভোগ করে, সে সমস্ত যদি সে দৈবকৃত মনে করে তবে হৃষ্ট বা ব্যথিত হয় না। যাঁর কিছুই নেই তিনি সুখে শয়ন করেন, সুখে উত্থান করেন; তাঁর শত্রু হয় না। রাজ্যের তুলনায় অকিঞ্চনতারই গুণ অধিক। বিদেহরাজ জনক বলেছিলেন, আমার বিত্তের অন্ত নেই, তথাপি আমার কিছুই নেই; মিথিলারাজ্য দগ্ধ হয়ে গেলেও আমার কিছু নষ্ট হয় না।

 দানবরাজ প্রহ্লাদ এক ব্রাহ্মণকে বলেছিলেন, আপনি নির্লোভ শুদ্ধস্বভাব দয়ালু জিতেন্দ্রিয় অসূয়াহীন মেধাবী ও প্রাজ্ঞ, তথাপি বালকের ন্যায় বিচরণ করেন। আপনি লাভালাভে তুষ্ট বা দুঃখিত হন না, ধর্ম অর্থ ও কামেও আপনি উদাসীন। আপনার তত্ত্বজ্ঞান শাস্ত্র ও আচরণ কিরূপ তা আমাকে বলুন। ব্রাহ্মণ বললেন, প্রহ্লাদ, অজ্ঞাত কারণ থেকে জীবগণের উৎপত্তি ও বিনাশ হয়; মহাকায় ও সূক্ষ্ম, স্থাবর ও জঙ্গম সকল জীবেরই মৃত্যু হয়; আকাশচারী জ্যোতিষ্কগণেরও পতন হয়। সকলেই মৃত্যুর বশীভূত এই জেনে আমি সুখে নিদ্রা যাই। যদি লোকে দেয় তবে উৎকৃষ্ট খাদ্য প্রচুর পরিমাণে খাই, না পেলে অভুক্ত থাকি। কখনও অন্নের কণা, কখনও পিণ্যাক (তিলের খোল), কখনও পলান্ন খাই; কখনও পর্যঙ্কে কখনও ভূমিতে শুই; কখনও চীর কখনও মহামূল্য বস্ত্র পরি। স্বধর্ম থেকে চ্যুত না হয়ে রাগদ্বেষাদি ত্যাগ ক’রে পবিত্রভাবে আমি অজগরব্রত আচরণ করছি। অজগর সর্প যেমন দৈবক্রমে লব্ধ খাদ্যে তুষ্ট থাকে, আমিও সেইরূপ যদৃচ্ছাগত বিষয়েই তুষ্ট থাকি। আমার শয়ন ভোজনের নিয়ম নেই, আমি সুখের অনিত্যতা উপলব্ধি ক’রে পবিত্রভাবে আত্মনিষ্ঠ হয়ে এই অজগরব্রত পালন করছি।