পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৬১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
শান্তিপর্ব
৫৮৩

নয়। বৃষের দেহবৃদ্ধির সঙ্গে যেমন তার শক্তিও বৃদ্ধি পায়, সেইরূপ ধনবৃদ্ধির সঙ্গে বিষয়তৃষ্ণাও বর্ধিত হয়। সামান্য বস্তুতেও যদি মমতা হয় তবে তা নষ্ট হ’লে দুঃখ হয়; অতএর কামনা ত্যাগ করাই উচিত। জ্ঞানী লোকে সর্বভূতকে আপনার তুল্য মনে করেন এবং কৃতকৃত্য ও বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে সবই ত্যাগ করতে পারেন। মন্দবুদ্ধি লোকের পক্ষে যা ত্যাগ করা দুঃসাধ্য, দেহ জীর্ণ হ’লেও যা জীর্ণ হয় না, যা আমরণস্থায়ী রোগের তুল্য, সেই বিষয়তৃষ্ণাকে যিনি ত্যাগ করেন তিনিই সুখী হন।

 যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, লোকে আমাদের ধন্য ধন্য বলে, কিন্তু আমাদের চেয়ে দুঃখী কেউ নেই। কবে আমরা রাজ্য ত্যাগ ক’রে সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করতে পারব যাতে সকল দঃখের অবসান হবে?

 ভীষ্ম বললেন, মহারাজ, ঐশ্বর্যকে দোষজনক মনে করো না। তোমরা ধর্মজ্ঞ, ঐশ্বর্য সত্ত্বেও শমদমাদি সাধন দ্বারা যথাকালে মোক্ষলাভ করবে। উদ্‌যোগী পুরুষের অবশ্যই ব্রহ্মলাভ হয়। পুরাকালে দৈত্যরাজ বৃত্র যখন নির্জিত রাজ্যহীন ও অসহায় হয়ে শত্রুগণের মধ্যে অবস্থান করছিলেন তখন শুত্রুাচার্য তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, দানব, তুমি পরাজিত হয়েছ কিন্তু দুঃখিত হও নি কেন? বৃত্র বললেন, আমি সংসার ও মোক্ষের তত্ত্ব জানি সেজন্য আমার শোক বা হর্ষ হয় না। পূর্বে আমি ত্রিলোক জয় করেছিলাম, তপস্যা দ্বারা ঐশ্বর্য লাভ করেছিলাম, কিন্তু আমার কর্মদোষে সব নষ্ট হয়েছে। এখন আমি ধৈর্য অবলম্বন ক’রে শোকহীন হয়েছি। ইন্দ্রের সহিত যুদ্ধের সময় আমি ভগবান হরিনারায়ণ সনাতন বিষ্ণুকে দেখেছিলাম, যাঁর কেশ মুঞ্জতৃণের ন্যায় পীতবর্ণ, শ্মশ্রু পিঙ্গলবর্ণ, যিনি সর্বভূতের পিতামহ। আমার সেই পুণ্যের ফল এখনও কিছু অবশিষ্ট আছে, তারই প্রভাবে আপনাকে প্রশ্ন করছি — ব্রহ্ম কোথায় অবস্থান করেন? জীব কি প্রকারে ব্রহ্মত্ব লাভ করে?

 এই সময়ে মহামুনি সনৎকুমার সেখানে উপস্থিত হলেন। শুক্র তাঁকে বললেন, আপনি এই দানবরাজের নিকট বিষ্ণুর মাহাত্ম্য কীর্তন করুন। সনৎকুমার বললেন, মহাবাহু, এই জগং বিষ্ণুতেই অবস্থান করছে, তিনিই সমস্ত সৃষ্টি এবং লয় করেন। তপস্যা ও যজ্ঞ দ্বারা তাঁকে পাওয়া যায় না; যিনি ইন্দ্রিয়সংযম ও চিত্তশোধন করেছেন, যাঁর বুদ্ধি নির্মল হয়েছে, তিনিই পরলোকে মোক্ষলাভ করেন। স্বর্ণকার যেমন বহুবার অগ্নিতে নিক্ষেপ ক’রে অতি যত্নে স্বর্ণ শোধন করে, জীবও সেইরূপ বহুবার জন্মগ্রহণ ক’রে কর্ম দ্বারা বিশুদ্ধি লাভ করে।