পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৬১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
শান্তিপর্ব
৫৯১

 পরদিন জনক রাজা মস্তকে অর্ঘ্য ধারণ ক’রে তাঁর গুরুপুত্র শুকদেবের কাছে এলেন। যথাবিধি সংবর্ধনা ও কুশলজিজ্ঞাসার পর শুকদেবের প্রশ্নের উত্তরে জনক ব্রাহ্মণের কর্ত্তব্য সম্বন্ধে উপদেশ দিলেন। শুক বললেন, মহারাজ, যার মনে রাগদ্বেষাদি দ্বন্দ্ব নেই এবং শাশ্বত জ্ঞানবিজ্ঞান উৎপন্ন হয়েছে, তাকেও কি ব্রহ্মচর্য গার্হস্থ্য ও বানপ্রস্থ এই তিন আশ্রমে বাস করতে হবে? জনক বললেন, জ্ঞানবিজ্ঞান বিনা মোক্ষ হয় না এবং গুরু উপদেশ ভিন্ন জ্ঞানলাভও হয় না। যাতে লোকাচার ও কর্মকাণ্ডের উচ্ছেদ না হয় সেজন্যই ব্রহ্মচর্যাদি চতুরাশ্রম বিহিত হয়েছে। একে একে চার আশ্রমের ধর্ম পালন ক’রে ক্রমশ শুভাশভ কর্ম ত্যাগ করলে মোক্ষলাভ হয়। কিন্তু বহু জন্মের সাধনার ফলে যাঁর চিত্তশুদ্ধি হয়েছে তিনি ব্রহ্মচর্যাশ্রমেই মোক্ষলাভ করেন, তাঁর অপর তিন আশ্রমের প্রয়োজন হয় না।

 তার পর জনক মোক্ষবিষয়ক বহু উপদেশ দিলেন। শুকদেব আত্মজ্ঞান লাভ ক’রে কৃতার্থ হয়ে হিমালয়ের পূর্ব দিকে তাঁর পিতার নিকট উপস্থিত হলেন। ব্যাসদেব সেখানে সুমন্ত্র বৈশম্পায়ন জৈমিনি ও পৈল এই চার শিষ্যের সঙ্গে শুকদেবকেও বেদাধ্যয়ন করাতে লাগলেন। শিক্ষা সমাপ্ত হ’লে শিষ্যগণ এই বর প্রার্থনা করলেন, ভগবান, আমরা চার জন এবং গুরুপুত্র শুক—এই পাঁচ জন ভিন্ন আর কেউ যেন বেদের প্রতিষ্ঠাতা না হয়। ব্যাসদেব সম্মত হয়ে বললেন, তোমরা উপযুক্ত শিক্ষার্থীকে উপদেশ দিয়ে বেদের বহু প্রচার কর; শিষ্য ব্রতচারী ও পুণ্যাত্মা ভিন্ন অন্য কোনও লোককে, এবং চরিত্র পরীক্ষা না ক’রে বেদশিক্ষা দান করবে না। শিষ্যগণ তুষ্ট হয়ে পরস্পরকে আলিঙ্গন এবং ব্যাসকে প্রণাম ক’রে প্রস্থান করলেন এবং অগ্নিহোত্রাদির মন্ত্র রচনা, যজ্ঞানুষ্ঠান ও অধ্যাপনা ক’রে বিখ্যাত হলেন।

 শিষ্যগণ চ’লে গেলে ব্যাসদেব তাঁর পুত্রের সঙ্গে নীরবে ব’সে রইলেন। সেই সময়ে নারদ এসে বললেন, হে বশিষ্ঠবংশীয় মহর্ষি, বেদধ্বনি শুনছি না কেন, তুমি নীরবে ধ্যানস্থ হয়ে রয়েছ কেন? ব্যাস বললেন, শিষ্যগণের বিচ্ছেদে আমার মন নিরানন্দ হয়েছে। নারদ বললেন, বেদের দোষ বেদপাঠ না করা, ব্রাহ্মণের দোষ ব্রত না করা, পৃথিবীর দোষ বাহীক[১] দেশ, স্ত্রীলোকের দোষ কৌতুহল। অতএব তুমি পুত্রের সঙ্গে বেদধ্বনি কর, রাক্ষসভয় দূর হ’ক।

 নারদের বাক্যে হৃষ্ট হয়ে ব্যাসদেব তাঁর পত্রের সঙ্গে উচ্চকণ্ঠে বেদপাঠ করতে লাগলেন। সেই সময়ে প্রবলবেগে বায়ু বইতে লাগল; অনধ্যায়কাল বিবেচনা ক’রে

  1. কর্ণপর্ব ১২-পরিচ্ছেদে বাহীকদেশের নিন্দা আছে।