পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৬২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
শান্তিপর্ব
৫৯৫

 পরদিন অতিথি চ’লে গেলে ব্রাহ্মণ নাগনগরের অভিমুখে যাত্রা করলেন এবং বহু বন তীর্থ সরোবর প্রভৃতি অতিক্রম ক’রে পদ্মনাভের পত্নীর নিকট উপস্থিত হলেন। ধর্মপরায়ণা নাগপত্নী বললেন, আমার পতি সূর্যের রথ বহন করবার জন্য গেছেন, সাত আট দিন পরে ফিরে আসবেন। ব্রাহ্মণ বললেন, আমি গোমতীতীরে যাচ্ছি, সেখানে অল্পাহারী হয়ে তাঁর প্রতীক্ষা করব। পদ্মনাভ যথাকালে তাঁর ভবনে ফিরে এলে নাগপত্নী তাঁকে জানালেন যে তাঁর দর্শনার্থী এক ব্রাহ্মণ গোমতীতীরে অনাহারে রয়েছেন, বহু অনুরোধেও তিনি আহার করেন নি, তাঁর কি প্রয়োজন তাও বলেন নি। পদ্মনাভ তখনই ব্রাহ্মণের কাছে গিয়ে তাঁর আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। ব্রাহ্মণ বললেন, আমার নাম ধর্মারণ্য; কৃষক যেমন জলধরের প্রতীক্ষা করে সেইরূপ আমি এত দিন তোমার প্রতীক্ষা করেছি। আমার প্রয়োজনের কথা পরে বলব, এখন তুমি আমার এই প্রশ্নের উত্তর দাও—তুমি পর্যায়ক্রমে সূর্যের একচক্র রথ বহন করতে যাও, সেখানে আশ্চর্য বিষয় কি দেখেছ?

 পদ্মনাভ বললেন, ভগবান রবি বহু আশ্চর্যের আধার। দেবগণ ও সিদ্ধ মুনিগণ তাঁর সহস্র রশ্মি আশ্রয় ক’রে বাস করেন, তাঁর প্রভাবেই সমীরণ প্রবাহিত হয়, বর্ষায় বারিপাত হয়; তাঁর মণ্ডলমধ্যবর্তী তেজোময় মহান আত্মা সর্বলোক নিরীক্ষণ করেন। তিনি বর্ষিত জল পবিত্র কিরণ দ্বারা আট মাস পুনর্বার গ্রহণ করেন, তাঁর জন্যই এই বসুন্ধরা বীজ ধারণ করে, তাঁর মধ্যে অনাদি অনন্ত পুরুষোত্তম বিরাজ করেন। এইসকল অপেক্ষা আশ্চর্য আর কি আছে? তথাপি আরও আশ্চর্য যা দেখেছি তা শুনুন। একদিন মধ্যাহ্নকালে যখন ভাস্কর সর্বলোক তাপিত করছিলেন তখন তাঁর অভিমুখে দ্বিতীয় আদিত্যতুল্য দীপ্তিমান অপর এক পুরুষকে আমি যেতে দেখলাম। সূর্যদেব তাঁর দিকে দুই হস্ত প্রসারিত ক’রে সংবর্ধনা করলেন, সেই তেজোময় পুরুষও সসম্মানে নিজের দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত ক’রে সূর্যের রশ্মিমণ্ডলে প্রবিষ্ট হলেন। উভয়ের মধ্যে কে সূর্য তা আর বোঝা গেল না। আমরা সূর্যকে জিজ্ঞাসা করলাম, ভগবান, দ্বিতীয়সূর্যতুল্য ইনি কে? সূর্য বললেন, ইনি অগ্নিদেব নন, অসুর বা পন্নগও নন; ইনি উঞ্ছবৃত্তি[১]-ব্রতধারী সমাধিনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ ছিলেন, অনাসক্ত এবং সর্বভূতহিতে রত হয়ে ফলমূল জীর্ণপত্র জল ও বায়ু ভক্ষণ ক’রে প্রাণধারণ করতেন। মহাদেবকে তুষ্ট ক’রে ইনি এখন সূর্যমণ্ডলে এসেছেন।

 ব্রাহ্মণ বললেন, নাগ, তোমার কথা আশ্চর্য বটে। আমি প্রীত হয়েছি,

  1. ক্ষেত্রে পতিত ধান্যাদি খুঁটে নেওয়া; অর্থাৎ অত্যল্প উপকরণে জীবিকানির্বাহ।