পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৬২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৯৮
মহাভারত

তুমি এই সর্পকে ক্ষমা ক’রে মুক্তি দাও। ব্যাধ বললে, একে মারলে বহু লোকের প্রাণরক্ষা হবে, অপরাধীকে বিনষ্ট করাই উচিত।

 ব্যাধ বার বার অনুরোধ করলেও গৌতমী সপর্বধে সম্মত হলেন না। তখন সেই সর্প মৃদুস্বরে মনুষ্যভাষায় ব্যাধকে বললে, মূর্খ অর্জুনক, আমার কি দোষ? আমি পরাধীন, ইচ্ছা ক’রে এই বালককে দংশন করি নি, মৃত্যু কর্তৃক প্রেরিত হয়ে করেছি; যদি পাপ হয়ে থাকে তবে মৃত্যুরই হয়েছে। ব্যাধ বললে, অন্যের বশবর্তী হলেও তুমি এই পাপকার্যের কারণ, সেজন্য বধযোগ্য। সর্প বললে, কেবল আমিই কারণ নই, বহু কারণের সংযোগে এই কার্য হয়েছে। ব্যাধ বললে, তুমিই এই বালকের প্রাণনাশের প্রধান কারণ, অতএব বধযোগ্য।

 সর্প ও ব্যাধ যখন এইরূপ বাদানুবাদ করছিল তখন স্বয়ং মৃত্যু সেখানে আবির্ভূত হয়ে বললেন, ওহে সর্প, আমি কাল কর্তৃক প্রেরিত হয়ে তোমাকে প্রেরণ করেছি, অতএব তুমি বা আমি এই বালকের বিনাশের কারণ নই। জগতে স্থাবর জঙ্গম সূর্য চন্দ্র বিষ্ণু ইন্দ্র জল বায়ু অগ্নি প্রভৃতি সমস্তই কালের অধীন, অতএব তুমি আমার উপর দোষারোপ করতে পার না। সর্প বললে, আপনাকে আমি দোষী বা নির্দোষী বলছি না, আমি আপনার প্রেরণায় দংশন করেছি—এই কথাই বলেছি; দোষ নির্ধারণ আমার কার্য নয়। ব্যাধ, তুমি মৃত্যুর কথা শুনলে, এখন আমাকে মুক্তি দাও। ব্যাধ বললে, তুমি যে নির্দোষ তার প্রমাণ হ’ল না, তুমি ও মৃত্যু উভয়েই এই বালকের বিনাশের কারণ, তোমাদের ধিক।

 এমন সময় স্বয়ং কাল আবির্ভূত হয়ে ব্যাধকে বললেন, আমি বা মৃত্যু বা এই সর্প কেউ অপরাধী নই, এই শিশু নিজ কর্মফলেই বিনষ্ট হয়েছে। কুম্ভকার যেমন মৃৎপিণ্ড থেকে ইচ্ছানুসারে বস্তু উৎপাদন করে, মানুষও সেইরূপ আত্মকৃত কর্মের ফল পায়। এই শিশু নিজেই তার বিনাশের কারণ।

 গৌতমী বললেন, কাল বা সর্প বা মৃত্যু কেউ এই বালকের বিনাশের কারণ নয়, নিজ কর্মফলেই এ বিনষ্ট হয়েছে, আমিও নিজ কর্মফলে পুত্রহীনা হয়েছি। অতএব কাল ও মৃত্যু এখন প্রস্থান করুন, তুমিও সর্পকে মুক্তি দাও। গৌতমী এইরূপ বললে কাল ও মৃত্যু চ’লে গেলেন, ব্যাধ সর্পকে ছেড়ে দিলে, গৌতমীও শোকশূন্য হলেন।

 উপাখ্যান শেষ ক’রে ভীষ্ম বললেন, মহারাজ, যুদ্ধে যাঁরা নিহত হয়েছেন তাঁরা সকলেই কালের প্রভাবে নিজ কর্মের ফল পেয়েছেন, তোমার বা দুর্যোধনের কর্মের জন্য তাঁদের মরণ হয় নি। অতএব তুমি শোক ত্যাগ কর।