পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৬২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
অনুশাসন পর্ব
৬০১

হয়ে সেই বাণ একটি বিশাল বৃক্ষে বিদ্ধ হ’ল। সেই বৃক্ষের কোটরে একটি শুকপক্ষী বহু কাল থেকে বাস করত। বিষের প্রভাবে বৃক্ষ ফলপত্রহীন ও শুষ্ক হয়ে গেল, কিন্তু আশ্রয়দাতার প্রতি ভক্তির জন্য শুক সেই বনম্পতিকে ত্যাগ করলে না, অনাহারে ক্ষীণদেহে সেখানেই রইল। দেবরাজ ইন্দ্র সেই উদারস্বভাব কৃতজ্ঞ সমব্যথী শুকের আচরণে আশ্চর্য হলেন এবং ব্রাহ্মণের বেশে উপস্থিত হয়ে বললেন, পক্ষিশ্রেষ্ঠ শুক, তুমি এই ফলপত্রহীন শুষ্ক তরু ত্যাগ করে অন্যত্র যাচ্ছ না কেন? এই মহারণ্যে আশ্রয়যোগ্য আরও তো অনেক বৃক্ষ আছে। শুক বললে, দেবরাজ, আমি এখানেই জন্মেছি এবং নিরাপদে প্রতিপালিত হয়েছি। আমি এই বৃক্ষের ভক্ত, এর দুঃখে দুঃখিত এবং অনন্যগতি। আপনি ধর্মজ্ঞ হয়ে কেন আমাকে অন্যত্র যেতে বলছেন? এই বৃক্ষ যখন সুস্থ ছিল তখন আমি এর আশ্রয়ে ছিলাম, আজ আমি কি ক’রে একে ছেড়ে যেতে পারি? শুকের কথা শুনে ইন্দ্র অতিশয় প্রীত হলেন এবং তার প্রার্থনায় অমৃত সেচন ক’রে বৃক্ষকে পুনর্জীবিত করলেন।

 ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, বৃক্ষ যেমন শুককে আশ্রয় দিয়ে উপকৃত হয়েছিল, লোকেও সেইরূপ ভক্তজনকে আশ্রয় দিয়ে সর্ব বিষয়ে সিদ্ধিলাভ করে।

 যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, দৈব ও পুরুষকার এই দুইএর মধ্যে কোন্‌টি শ্রেষ্ঠ? ভীষ্ম বললেন, এ সম্বন্ধে লোকপিতামহ ব্রহ্মা বশিষ্ঠকে যা বলেছিলেন শোন।—কৃষক তার ক্ষেত্রে যেরূপ বীজ বপন করে সেইরূপ ফল উৎপন্ন হয়; মানুষও তার সৎকর্ম ও অসৎকর্ম অনুসারে বিভিন্ন ফল লাভ করে। ক্ষেত্র ব্যতীত ফল উৎপন্ন হয় না, পুরুষকার ব্যতীত দৈবও সিদ্ধ হয় না। পণ্ডিতগণ পুরুষকারকে ক্ষেত্রের সহিত এবং দৈবকে বীজের সহিত তুলনা করেন। যেমন ক্ষেত্র ও বীজের সংযোগে, সেইরূপ পুরুষকার ও দৈবের সংযোগে ফল উৎপন্ন হয়। ক্লীব পতির সহিত স্ত্রীর সহবাস যেমন নিষ্ফল, কর্ম ত্যাগ করে দৈবের উপর নির্ভরও সেইরূপ। পুরুষকার দ্বারাই লোকে স্বর্গ, ভোগ্য বিষয় ও পাণ্ডিত্য লাভ করে। কৃপণ ক্লীব নিষ্ক্রিয় অকর্মকারী দুর্বল ও যত্নহীন লোকের অর্থলাভ হয় না। পুরুষকার অবলম্বন ক’রে কর্ম করলে দৈব তার সহায়ক হয়, কিন্তু কেবল দৈবে কিছুই পাওয়া যায় না। পুণ্যই দেবগণের আশ্রয়, পুণ্যকর্ম দ্বারা সমস্তই পাওয়া যায়, পুণ্যশীল লোকে দৈবকেও অতিক্রম করেন। দৈবের প্রভুত্ব নেই, শিষ্য যেমন গুরুর অনুসরণ করে দৈব সেইরূপে পুরুষকারের অনুসরণ করে।