পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৬৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
অনুশাসনপর্ব
৬১১

তোমার গুরুপত্নীকে সাবধানে রক্ষা করবে। সুরেশ্বর ইন্দ্র রুচিকে সর্বদা কামনা করেন; তিনি বহুপ্রকার মায়া জানেন, বজ্রধারী কিরীটী, চণ্ডাল, জটাচীরধারী, কুরূপ, রূপবান, যুবা, বৃদ্ধ, ব্রাহ্মণ বা অন্য বর্ণ, পশুপক্ষী বা মক্ষিকামশকাদির রূপ ধারণ করতে পারেন। তিনি বায়ুরূপেও এখানে আসতে পারেন। দুষ্ট কুক্কুর যেমন যজ্ঞের ঘৃত লেহন করে, সেইরূপ দেবরাজ যেন রুচিকে উচ্ছিষ্ট না করেন।

 দেবশর্মা চ’লে গেলে বিপুল ভাবলেন, মায়াবী ইন্দ্রকে নিবারণ করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য, আমি পৌরুষ দ্বারা গুরুপত্নীকে রক্ষা করতে পারব না। অতএব আমি যোগবলে এঁর শরীরে প্রবেশ করে পদ্মপত্রে জলবিন্দুর ন্যায় নির্লিপ্ত হয়ে অবস্থান করব, তাতে আমার অপরাধ হবে না। এইরূপ চিন্তা ক’রে মহাতপা বিপুল রুচির নিকটে বসলেন এবং নিজের নেত্ররশ্মি রুচির নেত্রে সংযোজিত করে বায়ু যেমন আকাশে যায় সেইরূপ গুরুপত্নীর দেহে প্রবেশ করলেন। রুচি স্তম্ভিত হয়ে রইলেন, তাঁর দেহমধ্যে বিপুল ছায়ার ন্যায় অবস্থান করতে লাগলেন।

 এমন সময় ইন্দ্র লোভনীয় রূপ ধারণ ক’রে সেখানে এসে দেখলেন, আলেখ্যে চিত্রিত মূর্তির ন্যায় বিপুল স্তব্ধনেত্রে ব’সে আছেন, তাঁর নিকটে পূর্ণচন্দ্রনিভাননা পদ্মপলাশাক্ষী রুচিও রয়েছেন। ইন্দ্রের রূপ দেখে বিস্মিত হয়ে রুচি দাঁড়িয়ে উঠে বলবার চেষ্টা করলেন, “তুমি কে?” কিন্তু পারলেন না। ইন্দ্র মধুরবাক্যে বললেন, সুন্দরী, আমি ইন্দ্র, কামার্ত হযে তোমার কাছে এসেছি, আমার অভিলাষ পূর্ণ কর। রুচিকে নিশ্চেষ্ট ও নির্বিকার দেখে ইন্দ্র আবার তাঁকে আহ্বান করলেন, রুচিও উত্তর দেবার চেষ্টা করলেন। তখন বিপুল গুরু পত্নীর মুখ দিয়ে বললেন, কিজন্য এসেছ? এই বাক্য নির্গত হওয়ায় রুচি লজ্জিত হলেন, ইন্দ্রও উদ্‌বিগ্ন হলেন। তার পর দেবরাজ দিব্যদৃষ্টি দ্বারা দেখলেন, মহাতপা বিপুল দর্পণস্থ প্রতিবিম্বের ন্যায় রুচির দেহমধ্যে রয়েছেন। ইন্দ্র শাপের ভয়ে ত্রস্ত হয়ে কাঁপতে লাগলেন। বিপুল তখন নিজের দেহে প্রবেশ ক’রে বললেন, অজিতেন্দ্রিয় দুর্বুদ্ধি পাপাত্মা পুরন্দর, তুমি দেবতা আর মানুষের পূজা অধিক দিন ভোগ করবে না; গৌতমের শাপে তোমার সর্বদেহে যোনিচিহ হয়েছিল তা কি ভুলে গেছ? আমি গুরু পত্নীকে রক্ষা করছি, তুমি দূর হও, আমার গুরু তোমাকে দেখলে এখনই দগ্ধ ক’রে ফেলবেন। তুমি নিজেকে অমব ভেবে আমাকে অবজ্ঞা ক’রো না, তপস্যার অসাধ্য কিছু নেই।

 ইন্দ্র কোনও উত্তর দিলেন না, লজ্জিত হয়ে তখনই অন্তর্হিত হলেন।