পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
আদিপর্ব
৩৭

হয়েছে। তার পর তিনি শিষ্যদের বললেন, নারীরা দীর্ঘকাল পিতৃগৃহে বাস করলে নিন্দা হয়, তাতে সুনাম চরিত্র ও ধর্ম ও নষ্ট হ’তে পারে। অতএব তোমরা শীঘ্র শকুন্তলা আর তার পুত্রকে দুষ্মন্তের কাছে দিয়ে এস।

 শকুন্তলাকে রাজভবনে পৌঁছিয়ে দিয়ে শিষ্যরা ফিরে গেলেন। শকুন্তলা দুষ্মন্তের কাছে গিয়ে অভিবাদন ক’রে বললেন, রাজা, এই তোমাব পুত্র, আমার গর্ভে জন্মেছে। কণ্বের আশ্রমে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলে তা স্মরণ কর, একে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত কর। পূর্বকথা স্মরণ হ’লেও রাজা বললেন, আমার কিছু মনে পড়ছে না, দুষ্ট তাপসী, তুমি কে? তোমার সঙ্গে আমার ধর্ম অর্থ বা কামের কোনও সম্বন্ধ হয় নি, তুমি যাও বা থাক বা যা ইচ্ছা করতে পার।

 লজ্জায় ও দুঃখে যেন সংজ্ঞাহীন হয়ে শকুন্তলা স্তম্ভের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর চক্ষু রক্তবর্ণ হ’ল, ওষ্ঠ কাঁপতে লাগল, বক্র কটাক্ষে তিনি যেন রাজাকে দগ্ধ করতে লাগলেন। তিনি তাঁর ক্রোধ ও তেজ দমন ক’রে বললেন, মহারাজ, তোমার স্মরণ থাকলেও প্রাকৃত জনের ন্যায় কেন বলছ যে মনে নেই? তুমি সত্য বল, মিথ্যা বলে নিজেকে অপমানিত ক’রো না। আমি তোমার কাছে যাচিকা হয়ে এসেছি, যদি আমার কথা না শোন তবে তোমার মস্তক শতধা বিদীর্ণ হবে। আমাকে যদি পরিত্যাগ কর তবে আমি আশ্রমে ফিরে যাব, কিন্তু এই বালক তোমার আত্মজ, একে ত্যাগ করতে পার না।

 দুষ্মন্ত বললেন, তোমার গর্ভে আমার পুত্র হয়েছিল তা আমার মনে নেই। নারীরা মিথ্যা কথাই বলে থাকে। তোমার জননী মেনকা অসতী ও নির্দয়া, ব্রাহ্মণত্বলোভী তোমার পিতা বিশ্বামিত্র কামুক ও নির্দয়। তুমি নিজেও ভ্রষ্টার ন্যায় কথা বলছ। দুষ্ট তাপসী, দূর হও। শকুন্তলা বললেন, মেনকা দেবতাদের মধ্যে গণ্যা। রাজা, তুমি ভূমিতে চল, আমি অন্তরীক্ষে চলি, ইন্দ্রকুবেরাদির গৃহে যেতে পারি। যে নিজে দুর্জন সে সজ্জনকে দুর্জন বলে, এর চেয়ে হাস্যকর কিছু নেই। যদি তুমি মিথ্যারই অনুরক্ত হও তবে আমি চ’লে যাচ্ছি, তোমার সঙ্গে আমার মিলন সম্ভব হবে না। দুষ্মন্ত, তোমার সাহায্য না পেলেও আমার পুত্র হিমালয়ভূষিত চতুঃসাগরবেষ্টিত এই পৃথিবীতে রাজত্ব করবে। এই বলে শকুন্তলা চ’লে গেলেন।

 তখন দুষ্মন্ত অন্তরীক্ষ থেকে এই দৈববাণী শুনলেন—শকুন্তলা সত্য বলেছেন, তুমিই তাঁর পুত্রের পিতা, তাকে ভরণপোষণ কর, তার নাম ভরত হ’ক। রাজা হৃষ্ট হয়ে পুরোহিত ও অমাত্যদের বললেন, আপনারা দেবদূতের কথা