পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৬৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৩৬
মহাভারত

সেজন্য এখন আবার সেই উপদেশ শুনতে ইচ্ছা করি। অর্জুনকে আলিঙ্গন ক’রে কৃষ্ণ বললেন, আমি তোমাকে নিগূঢ় সনাতন ধর্মতত্ত্ব এবং শাশ্বত লোক সম্বন্ধে উপদেশ দিয়েছিলাম, কিন্তু বুদ্ধির দোষে তুমি তা গ্রহণ করতে পার নি, এতে আমি দুঃখিত হয়েছি। আমি যোগযুক্ত হয়ে পূর্বে যে ব্রহ্মতত্ত্ব বিবৃত করেছিলাম এখন আর তা বলতে পারব না। যাই হক, এক সিদ্ধ ব্রাহ্মণ ধর্মাত্মা কশ্যপকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন তাই আমি বলছি শোন।—

 মানুষ পণ্যেকর্মের ফলে উত্তম গতি পায় এবং দেবলোকে সুখভোগ করে, কিন্তু এই অবস্থা চিরস্থায়ী নয়। অতি কষ্টে উত্তম লোক লাভ হ’লেও তা থেকে বার বার পতন হয়। দেহধারী জীব বিপরীত বুদ্ধির বশে অসৎ কর্মে প্রবৃত্ত হয়; সে অতিভোজন করে বা অনাহারে থাকে, পরস্পরবিরোধী বস্তু ভোজন ও পান করে, ভুক্ত খাদ্য জীর্ণ না হতেই আবার খায়, দিবসে নিদ্রা যায়, অতিরিক্ত পরিশ্রম বা স্ত্রীসংসর্গের ফলে দুর্বল হয়। এইরূপে সে বায়ুপিত্তাদি প্রকোপিত করে এবং পরিশেষে প্রাণান্তকর রোগের কবলে পড়ে। কেউ কেউ উদ্‌বন্ধনাদির দ্বারা আত্মহত্যা করে।

 দেহত্যাগের সময় শরীরস্থ উষ্মা বায়ু দ্বারা প্রকোপিত হয়ে মর্মস্থান ভেদ করে, তখন জীবাত্মা বেদনাগ্রস্ত হয়ে দেহ থেকে নির্গত হন। সকল জীবই বার বার জন্মমৃত্যু ভোগ করে; মৃত্যুকালে যেমন জন্মকালেও তেমন ক্লেশ পায়। সনাতন জীবাত্মাই দেহের মধ্যে থেকে সকল কার্য সম্পাদন করেন। মৃত্যু হ’লেও তাঁর কৃত কর্মসকল তাঁকে ত্যাগ করে না, সেই কর্মবন্ধনের ফলে জীবের আবার জন্ম হয়। চক্ষুষ্মান লোকে দেখে অন্ধকারে খদ্যোত কখনও প্রকাশিত হচ্ছে কখনও লীন হচ্ছে, সেইরূপ সিদ্ধ পুরুষ জ্ঞানচক্ষু দ্বারা জীবের জন্ম মরণ ও পুনর্বার গর্ভপ্রবেশ দেখতে পান। সংসার রূপ কর্মভূমিতে শুভাশুভ কর্ম ক’রে কেউ এখানেই ফলভোগ করে, কেউ পুণ্যবলে স্বর্গে যায়, কেউ অসৎ কর্মের ফলে নরকে পতিত হয়; সেই নরক থেকে মুক্তিলাভ অতি দুরূহ। মৃত্যুর পর পুণ্যাত্মারা চন্দ্র সূর্যে অথবা নক্ষত্রলোকে যান, কর্মক্ষয় হ’লে আবার তাঁরা মর্ত্যলোকে ফিরে আসেন; এইরূপ যাতায়াত বার বার ঘটে। স্বর্গেও উচ্চ মধ্যম ও নীচ স্থান আছে।

 শুক্র ও শোণিত সংযুক্ত হয়ে স্ত্রীজাতির গর্ভাশয়ে প্রবেশ ক’রে জীবের কর্মানুসারে দেহে পরিণত হয়। দেহের অধিষ্ঠাতা জীবাত্মা অতি সূক্ষ্ম ও অদৃশ্য, ইনি কোনও বিষয়ে লিপ্ত হন না। ইনিই শাশ্বত ব্রহ্ম এবং সর্বপ্রাণীর বীজস্বরূপ; এঁর প্রভাবেই প্রাণীরা জীবিত থাকে। বহ্নি যেমন অনুপ্রবিষ্ট হয়ে লৌহপিণ্ডকে