পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৬৮৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৫৮
মহাভারত

গান্ধারীও অতি কষ্টে ধৈর্য ধ’রে আছেন; এঁদের বনে যেতে দাও, যেন এখানে এঁদের মৃত্যু না হয়। অন্তকালে রাজাদের অরণ্যবাসই শ্রেয়। যুদ্ধে অথবা যথাবিধি অরণ্যে প্রাণত্যাগ করাই রাজর্ষিদের পরম ধর্ম। ধৃতরাষ্ট্রের তপস্যা করবার সময় হয়েছে, তোমার উপর এখন এঁর কিছুমাত্র ক্রোধ নেই।

 ব্যাসদেব চ’লে গেলে যুধিষ্ঠির বিনীত হয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, আপনার যা অভিলাষ ব্যাসদেব তাতে সম্মতি দিয়েছেন। কুরুরাজ, আমি নতমস্তকে অনুনয় করছি, এখন আহার করুন, পরে অরণ্যাশ্রমে যাবেন। জরাজীর্ণ গজপতির ন্যায় ধৃতরাষ্ট্র ধীরে ধীরে নিজ গৃহে গেলেন এবং আহ্নিকাদির পর আহার করলেন। গান্ধারী কুন্তী ও বধূগণ তাঁর পরিচর্যা করতে লাগলেন। ভোজনের পর ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরের পিঠে হাত রেখে রাজ্যপালন সম্বন্ধে বহু উপদেশ দিলেন, তার পর শ্রান্ত হয়ে গান্ধারীর গৃহে গেলেন।


 ধৃতরাষ্ট্রের অনুরোধে যুধিষ্ঠির কুরুজাঙ্গলের প্রজাগণকে ডেকে আনালেন। পুরবাসী ও জনপদবাসী ব্রাহ্মণাদি এবং নানা দেশ হ’তে আগত নরপতিগণ সমবেত হ’লে ধৃতরাষ্ট্র সকলকে সম্বোধন ক’রে বললেন, আপনারা বহুকাল কুরু কুলের সঙ্গে একত্র বাস করেছেন, আমরা পরস্পরের সুহৃৎ ও হিতৈষী। ব্যাসদেব ও রাজা যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে আমি গান্ধারীর সঙ্গে বনে যেতে ইচ্ছা করেছি, আপনারাও বিনা দ্বিধায় আমাকে অনুমতি দিন। আমি মনে করি, আমাদের সঙ্গে আপনাদের যে প্রীতির সম্বন্ধ আছে, অন্য দেশের রাজাদের সঙ্গে সে প্রকার নেই। গান্ধারী ও আমি পুত্রবিরহে কাতর হয়ে আছি, বয়স এবং উপবাসের জন্য দুর্বলও হয়েছি। যুধিষ্ঠিরের রাজত্বে আমরা প্রচুর সুখভোগ করেছি। এখন এই পুত্রহীন অন্ধ বৃদ্ধের বনগমন ভিন্ন আর কি গতি আছে? বৎসগণ, শান্তনুর পরে ভীষ্মপরিপালিত বিচিত্রবীর্য এবং পাণ্ডু এই রাজ্য পালন করেছিলেন; তার পর আমিও আপনাদের সেবা করেছি। যদি আমার ত্রুটি হয়ে থাকে তবে আপনারা ক্ষমা করবেন। মন্দবুদ্ধি দুর্যোধনও এই নিষ্কণ্টক রাজ্য ভোগ করেছে, কিন্তু আপনাদের কাছে সে কোনও অপরাধ করে নি। তার দুর্নীতির ফলে এবং আমার দোষে অসংখ্য মহীপাল যুদ্ধে প্রাণ হারিছেন। আমার কার্য ভাল বা মন্দ যাই হ’ক, আমি কৃতাঞ্জলি হয়ে বলছি— আপনারা তা মনে রাখবেন না। এই পুত্রহীন শোকাতুর অন্ধ বৃদ্ধকে পূর্বতন কুরুরাজগণের বংশধর ব’লে ক্ষমা করবেন। আমি ও দুঃখিনী গান্ধারী আপনাদের কাছে প্রার্থনা করছি—