পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৬৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৬৪
মহাভারত

আচ্ছাদিত হয়ে গেছে। এই বনের নির্জন প্রদেশে ব্রাহ্মণরা কখনও কখনও তাঁকে দেখতে পান।

 এই সময়ে যুধিষ্ঠির দূর থেকে শীর্ণদেহ দিগম্বর বিদুরকে দেখতে পেলেন, তাঁর মস্তকে জটা, মুখে বীটা[১], দেহ মললিপ্ত ও ধূলিধূসর। বিদুর আশ্রমের দিকে দৃষ্টিপাত ক’রেই চ’লে যাচ্ছিলেন, যুধিষ্ঠির বেগে তাঁর পশ্চাতে যেতে যেতে বললেন, ভো ভো বিদুর, আমি আপনার প্রিয় যুধিষ্ঠির, আপনাকে দেখতে এসেছি। বিদুর এক বৃক্ষে ঠেস দিয়ে অনিমেষনয়নে যুধিষ্ঠিরকে দেখতে লাগলেন, এবং তাঁর দৃষ্টিতে নিজের দৃষ্টি, গাত্রে গাত্র, প্রাণে প্রাণ এবং ইন্দ্রিয়গ্রামে ইন্দ্রিয়সকল সংযোজিত ক’রে যোগবলে যুধিষ্ঠিরের দেহে প্রবিষ্ট হলেন। যুধিষ্ঠিরের বোধ হ’ল তাঁর বল পূর্বাপেক্ষা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদুরের বৃক্ষাশ্রিত স্তব্ধলোচন প্রাণহীন দেহ দেখে তিনি ব্যাসের বাক্য[২] স্মরণ করলেন এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ইচ্ছা করলেন। এমন সময়ে তিনি দৈববাণী শুনলেন—রাজা, বিদুরের দেহ দগ্ধ ক’রো না, এঁর কলেবর যেখানে আছে সেখানেই থাকুক; ইনি যতিধর্ম প্রাপ্ত হয়ে সান্তানিক লোক লাভ করেছেন, এঁর জন্য শোক ক’রো না। তখন যুধিষ্ঠির আশ্রমে ফিরে গিয়ে সকল বৃত্তান্ত জানালেন, ধৃতরাষ্ট্র প্রভৃতি অত্যন্ত বিস্মিত হলেন।

 পরদিন প্রভাতকালে ব্যাসদেব শতযূপ প্রভৃতির সঙ্গে আশ্রমে উপস্থিত হলেন। কুশলপ্রশ্নের পর ব্যাস ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, কুরুরাজ, তুমি বিদুরের পরিণাম শুনেছ। ধর্মই মাণ্ডব্যের শাপে বিদুর রূপে জন্মেছিলেন[৩]। ব্রহ্মার আদেশে বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রে তোমার এই ভ্রাতাকে আমি উৎপাদন করেছিলাম। এই তপস্বী সত্যনিষ্ঠা ইন্দ্রিয়দমন শমগুণ অহিংসা ও দানের ফলে বিখ্যাত হয়েছেন। যুধিষ্ঠিরও ধর্ম থেকে উৎপন্ন হয়েছেন, যিনি ধর্ম তিনিই বিদুর, যিনি বিদুর তিনিই যুধিষ্ঠির। এই পাণ্ডুপুত্র যুধিষ্ঠির, যিনি তোমার আজ্ঞাবহ হয়ে আছেন, এঁর শরীরেই বিদুর যোগবলে প্রবিষ্ট হয়েছেন। পুত্র, আমি তোমার সংশয় ছেদনের জন্যই এখানে এসেছি। তোমার যদি কিছু প্রার্থনা থাকে, যদি কিছু দেখতে বা জানতে চাও, তো আমাকে ব’লো, আমি তোমার অভীষ্ট পূরণ করব।

  1. পুলির আকার কাষ্ঠখণ্ড, গুলিডাণ্ডা খেলার গুলির তুল্য। বাক্য ও আহার বর্জনের চিহ্ন।
  2. বিদুর ও যুধিষ্ঠির দুজনেই ধর্মের অংশ।
  3. আদিপর্ব ১৮-পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।