পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৬৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৬৬
মহাভারত

উৎপাদন করতে পারেন। তোমার মনস্তাপ দূর হ’ক। যাঁরা বলশালী তাঁদের পক্ষে সমস্তই হিতকর পবিত্র ধর্মসংগত ও স্বকীয়। তোমরা সকলেই সুপ্তোত্থিতের ন্যায় নিজ নিজ প্রিয়জনকে দেখতে পাবে। সেই বীরগণ ক্ষত্রধর্ম অনুসারে নিহত হয়েছেন, তাঁরা দেবকার্য সাধনের নিমিত্ত অবতীর্ণ হয়েছিলেন। গন্ধর্বরাজ ধৃতরাষ্ট্রই কুরুরাজ রূপে জন্মেছেন। পাণ্ডু মরূদ্‌গণ হ’তে উৎপন্ন হয়েছিলেন। বিদুর ও যুধিষ্ঠির ধর্মের অংশে জন্মেছেন। দুর্যোধন কলি, শকুনি দ্বাপর, দুঃশাসনাদি রাক্ষস, ভীমসেন বায়ু অর্জুন নর-ঋষি, কৃষ্ণ নারায়ণ, নকুল-সহদেব অশ্বিনীকুমারদ্বয়, অভিমন্যু চন্দ্র, কর্ণ সূর্য, ধৃষ্টদ্যুম্ন অগ্নি, শিখণ্ডী রাক্ষস, দ্রোণ বৃহস্পতি, অশ্বত্থামা রুদ্র, এবং ভীষ্ম বসু হ’তে উৎপন্ন। দেবগণই মনুষ্যরূপে পৃথিবীতে এসে নিজ নিজ কার্য সম্পন্ন ক’রে স্বর্গে ফিরে গেছেন। তোমরা সকলে ভাগীরথীতীরে চল, নিহত আত্মীয়গণকে সেখানে দেখতে পাবে।

 ব্যাস এইরূপ বললে সমাগত জনগণ সিংহনাদ ক’রে গঙ্গার অভিমুখে যাত্রা করলেন। ধৃতরাষ্ট্র, পঞ্চপাণ্ডব, অমাত্যগণ, নারীগণ, ঋষি ও গন্ধর্বগণ, অনুচরবর্গ, সকলেই গঙ্গাতীরে এসে অধীরভাবে রাত্রির প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। সায়াহ্নকাল উপস্থিত হ’লে তাঁরা পবিত্রভাবে একাগ্রমনে গঙ্গাতীরে উপবেশন করলেন। অনন্তর মহাতেজা ব্যাসদেব ভাগীরথীর পুণ্যজলে অবগাহন ক’রে মৃত কৌরব ও পাণ্ডব যোদ্ধা ও নরপতিগণকে আহ্বান করলেন। তখন জলমধ্যে কুরুপাণ্ডবসেনার তুমুল নিনাদ উঠল; ভীষ্ম দ্রোণ, পুত্রসহ বিরাট ও দ্রুপদ, অভিমন্যু ঘটোৎকচ কর্ণ, দুর্যোধন দুঃশাসন প্রভৃতি, শকুনি, জরাসন্ধপুত্র সহদেব, ভগদত্ত ভূরিশ্রবা শল্য বৃষসেন, দুর্যোধনপুত্র লক্ষ্মণ, সানুজ ধৃষ্টকেতু, বাহ্নীক সোমদত্ত চেকিতান প্রভৃতি বীরগণ দিব্য দেহ ধারণ ক’রে গঙ্গাগর্ভ থেকে সসৈন্যে উত্থিত হলেন। জীবদ্দশায় যাঁর যেপ্রকার বেশ ধ্বজ ও বাহন ছিল এখনও সেইপ্রকার দেখা গেল। অপ্সরা ও গন্ধর্বগণ স্তবগান করতে লাগলেন। ব্যাসদেব ধৃতরাষ্ট্রকে দিব্য চক্ষু দান করলেন। সকলে রোমাঞ্চিত হয়ে চিত্রপটে অঙ্কিতের ন্যায় এই আশ্চর্য উৎসব দেখতে লাগলেন।

 কুরু ও পাণ্ডব পক্ষের বীরগণ ক্রোধ ও দ্বেষ ত্যাগ ক’রে নিষ্পাপ হয়ে একত্র সমাগত হলেন। পুত্র পিতামাতার সহিত, ভার্যা পতির সহিত, ভ্রাতা ভ্রাতার সহিত এবং মিত্র মিত্রের সহিত সহর্ষে মিলিত হলেন। পাণ্ডবগণ কর্ণ অভিমন্যু ও দ্রৌপদীর পঞ্চ পুত্রের কাছে এলেন। মুনিবর ব্যাসের প্রসাদে সকলে আত্মীর ও বান্ধবের সহিত মিলিত হয়ে সেই রাত্রিতে স্বর্গবাসের সুখ অনুভব করলেন, তাঁদের শোক ভয় দুঃখ অযশ কিছুই রইল না। তাঁরা নিজ নিজ পত্নীর সহিত এক রাত্রি সুখে যাপন করলেন।