পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৭০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মৌষলপর্ব
৬৭৫

 অনন্তর অর্জুন বসুদেবের কাছে এসে দেখলেন, তিনি পুত্রশোকে সন্তপ্ত হয়ে শুয়ে আছেন। বসুদের বললেন, অর্জুন, আমার মৃত্যু নেই; যাঁরা শত শত নৃপতি ও দৈত্যগণকে জয় করেছিলেন, সেই পুত্রদের না দেখেও আমি জীবিত আছি। যে দুজন তোমার প্রিয় শিষ্য ছিল, যারা অতিরথ ব’লে খ্যাত এবং কৃষ্ণের প্রিয়তম ছিল, সেই প্রদ্যুম্ন ও সাত্যকিই বঞ্চিবংশনাশের মূল কারণ। অথবা আমি তাদের দোষ দিতে পারি না, ঋষিশাপেই আমাদের বংশ বিনষ্ট হয়েছে। তুমি ও নারদাদি মুনিগণ যাঁকে সনাতন বিষ্ণু ব’লে জানতে আমার পুত্র সেই গোবিন্দ যদুবংশের এই বিনাশ উপেক্ষা করেছেন, তিনি জ্ঞাতিদের রক্ষা করতে ইচ্ছা করেন নি। কৃষ্ণ আমাকে ব’লে গেছেন—‘আমি আর অর্জুন একই, অর্জুন দ্বারকায় এসে স্ত্রী ও বালকগণের রক্ষার ভার নেবেন এবং মৃতজনের ঔর্ধ্বদেহিক ক্রিয়া করবেন; তিনি প্রস্থান করলেই দ্বারকা সমুদ্রজলে প্লাবিত হবে। আমি বলদেবের সঙ্গে কোনও নির্জন স্থানে যোগস্থ হয়ে অন্তকালের প্রতীক্ষা করব।’

 তার পর বসুদেব বললেন, পার্থ, আমি আহার ত্যাগ করেছি, জীবনধারণে আমার ইচ্ছা নেই। কৃষ্ণের বাক্য অনুসারে এই রাজ্য, নারীগণ ও ধনরত্ন তোমাকে সমর্পণ করছি। অর্জুন বললেন, মাতুল, কৃষ্ণ ও বান্ধববিহীন এই পৃথিবী আমি দেখতে ইচ্ছা করি না। আমার ভ্রাতৃগণ ও দ্রৌপদীর মনের অবস্থাও অনুরূপ, কারণ আমরা ছ জন একাত্মা। রাজা যুধিষ্ঠিরেরও প্রয়াণকাল উপস্থিত হয়েছে, অতএব আমি স্ত্রী বালক ও বৃদ্ধদের নিয়ে সত্বর ইন্দ্রপ্রস্থে যাব।

 পরদিন প্রভাতকালে বসুদেব যোগস্থ হয়ে স্বর্গলাভ করলেন। দেবকী ভদ্রা মদিরা ও রোহিণী পতির চিতায় আরোহণ ক’রে তাঁর সহগামিনী হলেন। অর্জুন সকলের অন্তিম কার্য সম্পন্ন করলেন এবং বলরাম ও কৃষ্ণের দেহ অন্বেষণ ক’রে এনে সৎকার করলেন। সপ্তম দিনে তিনি কৃষ্ণের ষোল হাজার পত্নী, পৌত্র বজ্র[১], এবং অসংখ্য নারী বালক ও বৃদ্ধদের নিয়ে যাত্রা করলেন। রথী গজারোহী ও অশ্বারোহী অনুচরগণ এবং ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়াদি প্রজা তাঁদের সঙ্গে গেলেন। অর্জুন দ্বারকার যে যে স্থান অতিক্রম করতে লাগলেন তৎক্ষণাৎ সেই সেই স্থান সমুদ্রজলে প্লাবিত হ’ল।

 কিছু দিন পরে তাঁরা গবাদি পশু ও ধান্য সম্পন্ন পঞ্চনদ প্রদেশের এক স্থানে এলেন। সেখানকার আভীর দস্যুগণ যাদবনারীদের দেখে লুব্ধ হয়ে যষ্ঠি নিয়ে আক্রমণ করলে। অর্জুন ঈষৎ হাস্য ক’রে তাদের বললেন, যদি বাঁচতে চাও তো দূর

  1. ভাগবতে আছে, ইনি কৃষ্ণের প্রপৌত্র, প্রদ্যুম্নের পৌত্র, অনিরুদ্ধের পুত্র।