পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৭১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
স্বৰ্গারোহণপর্ব
৬৮৩

গন্ধযুক্ত, মাংসশোণিতের কর্দম অস্থি কেশ ও মৃতদেহে আচ্ছন্ন, এবং মশক মক্ষিকা কৃমি কীট ও ভল্লুকাদি হিংস্র প্রাণীতে সমাকীর্ণ। চতুর্দিকে অগ্নি জ্বলছে; লৌহমুখ কাক, সূচীমুখ গৃধ্র এবং পর্বতাকার প্রেতগণ ঘুরে বেড়াচ্ছে: মেদরুধিরলিপ্ত ছিন্নবাহু ছিন্নপাদ ছিন্নোেদর মৃতদেহ সর্বত্র পড়ে আছে। সেই পূতিগন্ধময় লোমহর্ষকর পথে যেতে যেতে যুধিষ্ঠির তপ্তজলপূর্ণ দুর্গম নদী, তীক্ষ্ণক্ষুরসমাকীর্ণ অসিপত্রবন, তপ্ততৈলপপূর্ণ লৌহকুম্ভ, তীক্ষ্ণকণ্টকময় শাল্মলী বৃক্ষ প্রভৃতি, এবং পাপীদের যন্ত্রণাভোগ দেখলেন। তিনি দেবদূতকে প্রশ্ন করলেন, এই পথ দিয়ে আর কত দূর যেতে হবে? আমার ভ্রাতারা কোথায়?

 দেবদূত বললেন, মহারাজ, আপনি শ্রান্ত হ’লেই দেবগণের আদেশ অনুসারে আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাব। মনঃকষ্টে ও দুর্গন্ধে গীড়িত হয়ে যুধিষ্ঠির প্রত্যাবর্তনের উপক্রম করলেন। তখন তিনি এই করুণ বাক্য শুনলেন—হে ধর্মপুত্র রাজর্ষি, দয়া ক’রে মুহূর্তকাল থাকুন। আপনার আগমনে সুগন্ধ পবিত্র বায়ু প্রবাহিত হচ্ছে, দীর্ঘকাল পরে আপনাকে দেখে আমরা সুখী হয়েছি, আমাদের যাতনাও নিবৃত্ত হয়েছে। দয়ালু যুধিষ্ঠির বার বার এইরূপ বাক্য শুনে প্রশ্ন করলেন, আপনারা কে, কেন এখানে আছেন? তখন চারিদিক হাতে উচ্চকণ্ঠে উত্তর এল—আমি কর্ণ, আমি ভীমসেন, আমি অর্জুন, আমি নকুল, আমি সহদেব, আমি ধৃষ্টদ্যুম্ন, আমি দ্রৌপদী, আমরা দ্রৌপদীপুত্র। যুধিষ্ঠির ভাবতে লাগলেন, দৈব এ কি করেছেন! কোন পাপের ফলে এঁরা এই পাপগন্ধময় নিদারুণ স্থানে আছেন? আমি সুপ্ত না জাগরিত, চেতন না অচেতন? এ কি আমার মনের বিকার না বিভ্রম? যুধিষ্ঠির দুঃখ ও দুশ্চিন্তায় ব্যাকুল হলেন এবং ক্রুদ্ধকণ্ঠে দেবদূতকে বললেন, তুমি যাঁদের দূত তাঁদের কাছে গিয়ে বল যে আমি ফিরে যাব না এখানেই থাকব, আমাকে পেয়ে আমার ভ্রাতারা সুখী হয়েছেন। দেবদূত ফিরে গিয়ে ইন্দ্রকে যুধিষ্ঠিরের বাক্য জানালেন।

 কিছুক্ষণ পরে ইন্দ্রাদি দেবগণ ও ধর্ম যুধিষ্ঠিরের কাছে এলেন। সহসা অন্ধকার দূর হ’ল, বৈতরণী নদী, লৌহকুম্ভ, কণ্টকময় শাল্মলী বৃক্ষ প্রভৃতি এবং বিকৃত শরীর সকল অদৃশ্য হ’ল, পাপীদের আর্তনাদ আর শোনা গেল না, শীতল সুগন্ধ পবিত্র বায়ু বইতে লাগল। সুরপতি ইন্দ্র বললেন, মহাবাহু যুধিষ্ঠির, দেবগণ তোমার উপর প্রীত হয়েছেন, তুমি আমাদের সঙ্গে এস। ক্রুদ্ধ হয়ো না, সকল রাজাকেই নরক দর্শন করতে হয়। সকল মানুষেরই পাপপুণ্য থাকে; যার পাপের ভাগ অধিক এবং পুণ্য অল্প সে প্রথমে স্বর্গ ভোগ ক’রে পরে নরকে যায়; যার পুণ্য