পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
আদিপর্ব
৫৯

 অর্জুনের কৌশলপ্রদর্শন শেষ হয়ে এসেছে এবং বাদ্যরবও মন্দীভূত হয়েছে এমন সময় দ্বারদেশে সহসা বজ্রধ্বনির ন্যায় বাহ্বাস্ফোট (তাল ঠোকার শব্দ) শোনা গেল। দ্বারপালরা পথ ছেড়ে দিলে কবচকুণ্ডলশোভিত মহাবিক্রমশালী কর্ণ পাদচারী পর্বতের ন্যায় রঙ্গভূমিতে এলেন এবং অধিক সম্মান না দেখিয়ে দ্রোণ ও কৃপকে প্রণাম করলেন। অর্জন যে তাঁর ভ্রাতা তা না জেনে কর্ণ বললেন, পার্থ, তুমি যা দেখিয়েছ তার সবই আমি দেখাব। এই ব’লে তিনি দ্রোণের অনুমতি নিয়ে অর্জুন যা যা করেছিলেন তাই ক’রে দেখালেন। দুর্যোধন আনন্দিত হ’য়ে কর্ণকে আলিঙ্গন করে বললেন, মহাবাহু, তোমাকে স্বাগত জানাচ্ছি, তুমি এই কুরুরাজ্য ইচ্ছামত ভোগ কর। কর্ণ বললেন, আমি তোমার সখ্য চাই, আর অর্জুনের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করতে চাই। দুর্যোধন বললেন, তুমি সখা হ’য়ে আমার সঙ্গে সমস্ত ভোগ কর আর শত্রুদের মাথায় পা রাখ।

 অর্জুন নিজেকে অপমানিত জ্ঞান ক’রে বললেন, কর্ণ, যারা অনাহূত হয়ে আসে আর অনাহূত হ’য়ে কথা বলে, তারা যে নরকে যায় আমি তোমাকে সেখানে পাঠাব। কর্ণ বললেন, এই রঙ্গভূমিতে সকলেরই আসবার অধিকার আছে। দুর্বলের ন্যায় আমার নিন্দা করছ কেন, যা বলবার শর দিয়েই বল। আজ গুরুর সমক্ষেই শরাঘাতে তোমার শিরশ্ছেদ করব। তার পর দ্রোণের অনুমতি নিয়ে অর্জুন তাঁর ভ্রাতাদের সঙ্গে কর্ণের সম্মুখীন হলেন, দুর্যোধন ও তাঁর ভ্রাতারা কর্ণের পক্ষে গেলেন। ইন্দ্র ও সূর্য নিজ নিজ পুত্রকে দেখতে এলেন, অর্জুনের উপর মেঘের ছায়া এবং কর্ণের উপর সূর্যের কিরণ পড়ল। দ্রোণ কৃপ ও ভীষ্ম অর্জুনের কাছে গেলেন। রঙ্গভূমি দুই পক্ষে বিভক্ত হওয়ায় স্ত্রীদের মধ্যেও দ্বৈধভাব উৎপন্ন হ’ল।

 কর্ণকে চিনতে পেরে কুন্তী মূর্ছিত হলেন, বিদুরের আজ্ঞায় দাসীরা চন্দনজল সেচন ক’রে তাঁকে প্রবুদ্ধ করলে। দুই পুত্রকে সশস্ত্র দেখে কুন্তী বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন। এই সময়ে কৃপাচার্য কর্ণকে বললেন, এই অজর্ন কুরুবংশজাত, পাণ্ডুকুন্তীর পুত্র, ইনি তোমার সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করবেন। মহাবাহু কর্ণ, তুমি তোমার মাতা পিতার কুল বল, কোন রাজবংশের তুমি ভূষণ? তোমার পরিচয় পেলে অর্জুন যুদ্ধ করা বা না করা স্থির করবেন, রাজপুত্রেরা তুচ্ছকুলশীল প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে যুদ্ধ করেন না। কৃপের কথায় কর্ণ বর্ষাজলসিক্ত পদ্মের ন্যায় লজ্জায় মস্তক নত করলেন। দুর্যোধন বললেন, আচার্য, অর্জুন যদি রাজা ভিন্ন অন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে না চান তবে আমি কর্ণকে অঙ্গরাজ্যে অভিষিক্ত করছি।