পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
আদিপর্ব
৬৫

প্রস্তুত করলে এবং তার প্রবেশের পথে কপাট লাগিয়ে ভূমির সমান করে দিলে, যাতে কেউ বুঝতে না পারে। পুরোচন গৃহের দ্বারদেশেই বাস করতেন সেজন্য সুরঙ্গের মুখ আবৃত করা হ’ল। পাণ্ডবরা দিবসে এক বন থেকে অন্য বনে মৃগয়া করতেন এবং রাত্রিকালে সশস্ত্র ও সতর্ক হয়ে সুরঙ্গের মধ্যে বাস করতেন।

 এইরূপে এক বৎসর অতীত হ’লে পুরোচন স্থির করলেন যে পাণ্ডবদের মনে কোনও সন্দেহ নেই। যুধিষ্ঠির তাঁর ভ্রাতাদের বললেন, এখন আমাদের পলায়নের সময় এসেছে, আমরা অন্ধকারে আগুন দিয়ে পুরোচনকে দগ্ধ করব এবং অন্য ছ জনকে এখানে রেখে চ’লে যাব। একদিন কুন্তী ব্রাহ্মণভোজন করালেন, অনেক স্ত্রীলোকও এল, তারা যথেচ্ছ পানভোজন করে রাত্রিতে চ’লে গেল। এক নিষাদ-স্ত্রী তার পাঁচ পুত্রকে নিয়ে খেতে এসেছিল, সে পুত্রদের সঙ্গে প্রচুর মদ্যপান ক’রে মৃতপ্রায় হয়ে গৃহমধ্যেই নিদ্রামগ্ন হ’ল। সকলে সুষুপ্ত হ’লে ভীম পুরোচনের শয়নগৃহে, জতুগৃহের দ্বারে এবং চতুর্দিকে আগুন লাগিয়ে দিলেন। পঞ্চপাণ্ডব ও কুন্তী সুরঙ্গে প্রবেশ করলেন। প্রবল বায়ুতে জতুগৃহের সর্বদিক জ্বলে উঠল, অগ্নির উত্তাপে ও শব্দে নগরবাসীরা জেগে উঠে বলতে লাগল পাপিষ্ঠ পুরোচন দুর্যোধনের আদেশে এই গৃহদাহ ক’রে পাণ্ডবদের বধ করেছে। দুর্বদ্ধি ধৃতরাষ্ট্রকে ধিক, যিনি নির্দোষ পাণ্ডবগণকে শত্রুর ন্যায় হত্যা করিয়েছেন। ভাগ্যক্রমে পাপাত্মা পুরোচনও পুড়ে মরেছে। বারণাবতবাসীরা জ্বলন্ত জতুগৃহের চতুর্দিকে থেকে এইরূপে বিলাপ করে রাত্রিযাপন করলে।

 পঞ্চপাণ্ডব ও কুন্তী অলক্ষিত হয়ে সুরঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে এলেন। নিদ্রার ব্যাঘাতে এবং ভয়ে তাঁরা চলতে পারলেন না। মহাবল ভীমসেন কুন্তীকে কাঁধে এবং নকুল-সহদেবকে কোলে নিয়ে যুধিষ্ঠির অর্জুনের হাত ধ’রে বেগে চললেন। বিদুরের একজন বিশ্বস্ত অনুচর গঙ্গার তীরে একটি বায়ুবেগসহ যন্ত্রযুক্ত পতাকাশোভিত নৌকা[১] রেখেছিল। পাণ্ডবগণকে গঙ্গার অপর পারে এনে বিদুরের অনুচর জয়োচ্চারণ করে চ’লে গেল।

 নৌকা থেকে নেমে পাণ্ডবরা নক্ষত্র দেখে পথনির্ণয় করে দক্ষিণ দিকে যেতে লাগলেন। দুর্গম দীর্ঘ পথ অতিক্রম ক’রে পরদিন সন্ধ্যাকালে তাঁরা হিংস্রপ্রাণিসমাকুল ঘোর অরণ্যে উপস্থিত হলেন। কুন্তী প্রভৃতি সকলে তৃষ্ণায় কাতর হওয়ায় ভীম

  1. ‘সর্ববাতসহাং নাবং যন্ত্রযুক্তাং পতাকিনীম্’।