পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
আদিপর্ব
৬৯

॥বকবধপর্বাধ্যায়॥

২৮। একচক্রা—বকরাক্ষস

 পাণ্ডবগণ একচক্রা নগরে সেই ব্রাহ্মণের গৃহে বাস করতে লাগলেন। তাঁরা ভিক্ষা ক’রে যা আনতেন, কুন্তী সেই সমস্ত খাদ্য দু ভাগ করতেন, এক ভাগ ভীম একাই খেতেন, অন্য ভাগ অপর চার ভ্রাতা ও কুন্তী খেতেন। এইরূপে বহু দিন গত হ’ল। একদিন যুধিষ্টিরাদি ভিক্ষা করতে গেছেন, কেবল ভীম আর কুন্তী গৃহে আছেন, এমন সময় তাঁরা তাঁদের আশ্রয়দাতা ব্রাহ্মণের গৃহে আর্তনাদ শুনতে পেলেন। কুন্তী অন্তঃপুরে গিয়ে দেখলেন, ব্রাহ্মণ তাঁর পত্নী পুত্র ও কন্যার সঙ্গে বিষণ্ণমুখে রয়েছেন। ব্রাহ্মণ বলছিলেন, ধিক মানুষের জীবন যা নল-তৃণের ন্যায় অসার, পরাধীন ও সকল দঃখের মূল। ব্রাহ্মণী, আমি নিরাপদ স্থানে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি দুর্বুদ্ধিবশত তোমার স্বর্গস্থ পিতামাতার এই গৃহ ছেড়ে যেতে চাও নি, তার ফলে এখন এই আত্মীয়নাশ হবে। যিনি আমার নিত্যসঙ্গিনী পতিব্রতা ধর্মপত্নী তাঁকে আমি ত্যাগ করতে পারি না, আমার বালিকা কন্যা বা পুত্রকেও ছাড়তে পারি না। যদি আমি নিজের প্রাণ বিসর্জন দিই তবে তোমরাও মরবে। হায়, আমাদের গতি কি হবে, সকলের এক সঙ্গে মরাই ভাল।

 ব্রাহ্মণী বললেন, তুমি প্রাকৃত জনের ন্যায় বিলাপ করছ কেন? লোকে নিজের জন্যই পত্নী ও পুত্রকন্যা চায়। তুমি থাক, আমি যাব, তাতে আমার ইহলোকে যশ এবং পরলোকে অক্ষয় পুণ্য হবে। লোকে ভার্যার কাছে যা চায় সেই পুত্রকন্যা তুমি পেয়েছ, তোমার অভাবে আমি তাদের ভরণপোষণ করতে পারব না। ভূমিতে মাংস প’ড়ে থাকলে যেমন পাখিরা লোলুপ হয় তেমনই পতিহীনা নারীকে সকলে কামনা করে, দুরাত্মা পুরুষেরা হয়তো আমাকে সৎপথ থেকে বিচলিত করবে। এই কন্যার বিবাহ এবং পুত্রের শিক্ষার ব্যবস্থা আমি কি ক’রে করব? আমার অভাবে তুমি অন্য পত্নী পাবে, কিন্তু আমার পক্ষে অন্য পতি গ্রহণ ঘোর অধর্ম। অতএব আমাকে যেতে দাও।

 এই কথা শুনে ব্রাহ্মণ তাঁর পত্নীকে আলিঙ্গন করে অশ্রুপাত করতে লাগলেন। তখন তাঁদের কন্যাটি বললে, একদিন আমাকে তো ছাড়তেই হবে, বরং এখনই আমাকে যেতে দাও, তাতে তোমরা সকলে নিস্তার পাবে, আমিও অমৃতলোক লাভ করব। বালক পুত্রটি উৎফুল্লনয়নে কলকণ্ঠে বললে, তোমরা কেঁদো না, আমি এই তৃণ দিয়ে সেই রাক্ষসকে বধ করব।