পাতা:মাঝির ছেলে - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪৫
মাঝির ছেলে

 নাগা কতকটা অভিভূত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কই যামু কর্তা।’

 সদরে যাদববাবুর দরকারী কাজ আছে। এই কাজেই তিনি ব্যস্ত ছিলেনু, হঠাৎ খবর আসে চাঁদ মাঝির অবস্থা খারাপ, ডাক্তারের একটা ইনজেকশনের ওষুধ অবিলম্বে দরকার। ওষুধটা নিয়ে যাদববাবু যত জোরে পারা যায় লঞ্চ চালিয়ে আটখামারে এসেছিলেন। কিন্তু-

 ‘চাঁদ মাঝি নাই, নাগা।’

 চাঁদ মাঝি নাই, কাঁচা পাকা একমাথা ঝাঁকড়া চুল নেড়ে গোলগাল বেঁটে যে চাঁদ মাঝি কথা কইত, যার মত একগুঁয়ে মানুষ নাগা কখনো দ্যাখে নি, সে আর নেই। এমন কি ঘনিষ্ঠত ছিল চাঁদ মাঝির সঙ্গে যে সে মারা গিয়েছে শুনে এমনভাবে নাগা অভিভূত হ’য়ে গেল? বোধ হয় যাদববাবুর বলবার ভঙ্গীতে। যাদববাবুকে প্রথম থেকেই গম্ভীর আর অন্যমনস্ক মনে হচ্ছিল। এবার নাগা বুঝতে পারল তার কারণ কি। মাইনে-করা একটা লোক-তুচ্ছ একটা মাঝি—তার মরণে যাদববাবুর মনে এমন আঘাত লেগেছে!

 তারপর যাদববাবু নিজের ছোট কেবিনে চলে যান। আর নাগা ঘুরে ঘুরে সব দেখে বেড়ায়। খানিকক্ষণ ইঞ্জিন দেখে সে গিয়ে দাঁড়ায় ভিমনার কাছে। জল নয়, লঞ্চ যেন বাতাস কেটে চলেছে। কোথায় এই জাহাজের হাল আর কোথায় দাঁড়িয়ে কাঠের চাকা ঘুরিয়ে ভিমনা জাহাজ চালাচ্ছে। সেও যদি এমনিভাবে পালিশ করা একটা চাকা দু’হাতে ধরে কল-বসানো এত বড় একটা নৌকা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারত! চাঁদ মাঝি নাই। চাঁদ মাঝি তাকে বলেছে একদিন সে জাহাজে চেপে সমুদ্রে যাবে।

 কিন্তু, এমনিভাবে অন্যের চালানো জাহাজে যাত্রীর মতো যাবে না, ভিমনার মত নিজে জাহাজটি চালিয়ে নিয়ে যাবে, তাতো কৈলাস চক্রবর্তী বলেন নি! সরে গিয়ে নাগা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। লঞ্চ চালাবার শব্দে সে যেন যাদববাবু আর কৈলাস চক্রবর্তী দু’জনের গলায় শুনতে পায়, ‘চাঁদ মাঝি নাই, নাগা—চাঁদ মাঝি নাই।’