পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

না, অতিশয় কঠোর উক্তিতে প্রত্যুত্তর করিল। ক্রমে বিবাদ বাড়িতে লাগিল, নরেন্দ্র অতি শীঘ্র ক্রোধে প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিল এবং অতিশয় অন্যায় কটুভাষায় শ্রীশকে তিরস্কার করিল। শ্রীশ এবার ক্রোধ সংবরণ করিতে পারিল না, বলিল, “তোমার মত অভদ্র লোকের সহিত কলহ করিলেও অপমান আছে।”

 এই অপমানসূচক কথায় নরেন্দ্রের ললাটের শিরা স্ফীত হইল, নয়ন প্রজ্বলিত হইল, সে শ্রীশকে প্রহার করিতে উঠিল; শ্রীশও উঠিয়া দাঁড়াইল। জ্ঞানশূন্য নরেন্দ্র সহসা শ্রীশকে ঠেলিয়া জলে ফেলিয়া দিল। “বাবু জলে পড়িল, জলে পড়িল” বলিয়া মাল্লারা চিৎকার করিয়া উঠিল, একজন ঝাঁপ দিয়া জলে পড়িল এবং শ্রীশকে প্রায়-অজ্ঞান অবস্থায় নৌকায় উঠাইল।

 সন্ধ্যার সময় নবকুমার নরেন্দ্রকে ডাকাইয়া যথেষ্ট ভর্ৎসনা করিয়া বলিলেন, “তুমি নাকি শ্রীশকে মাঝগঙ্গার জলে ফেলিয়া দিয়াছিলে? মাল্লারা না থাকিলে সে আজ ডুবিয়া মরিত?”

 নির্বোধ জ্ঞানশূন্য নরেন্দ্র উত্তর করিল, “সে আমার সহিত কলহ করিতে আসে কেন?”

 নবকুমার, শ্রীশের সহিত কলহ করিতে তোমার লজ্জা হয় না? জান না, তুমি কে আর শ্রীশ কে? তুমি কি শ্রীশের সমান।

 নরেন্দ্র ক্রোধকম্পিত-স্বরে বলিল, “আমি শ্রীশের সমান নহি; আমি জমিদার বীরেন্দ্র সিংহের পুত্র, শ্রীশ পথের কাঙ্গালী, পরের অন্নে পালিত, তাহার সমান আমি কিরূপে?”

 নবকুমার এরূপ উত্তর কথন শুনেন নাই; বিস্মিত ও ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, “কাহার সহিত কথা কহিতেছ, জান?”

 নরেন্দ্র। জানি, যে দরিদ্র সন্তান, আমার পিতা কর্তৃক পালিত হইয়া কালসর্পের ন্যায় তাঁহাকে দংশন করিয়াছে, এক্ষণে তাঁহার বিষয়টি লইয়াছে, সেই নবকুমারবাবুর সহিত কথা কহিতেছি।

 নবকুমার এক মুহূর্তের জন্য নিরুত্তর হইলেন। কি বিষয় তাঁহার স্মরণ হইতেছিল, বলিতে পারি না। পরক্ষণেই বলিলেন, “কৃতঘ্ন বালক। তোর পিতা নিজ দোযে জমিদারি হারাইয়াছে, অনাথকে এতদিন পালন করিলাম, তাহার এই ফল। আজ শ্রীশকে ডুবাইয়াছিলি, কাল আমার গলায় ছুরি দিবি। তুই আজই আমার বাড়ি হইতে দুর হ!”

 নরেন্দ্র। চলিলাম। কিন্তু যদি ইহজন্মে কি পরজন্মে বিচার থাকে, তুমি তাহার ফলভোগ করিবে।

 সায়ংকালে গঙ্গাতীরে হেমলতা একাকী বিচরণ করিতেছিল। যে যে ঘটনা

১৪