পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

হইয়াছিলেন, নরেন্দ্রনাথ মৃতপ্রায় হইয়া শহন্তে পড়িয়াছিলেন, তাহা তাহার অল্প-অল্প স্মরণ ছিল। শক্র কি অবশেষে তাঁহাকে জল্লাদহস্তে দিবার জন্য এইরূপ শুশ্রূষা করিতে ছিলেন? নরেন্দ্র কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না।

 রজনী দ্বিপ্রহর, নরেন্দ্রনাথ একখানি দ্বিরদরদখচিত আসনে উপবেশন করিয়া রহিয়াছেন। সম্মুখে এক দীপ জ্বলিতেছে। নরেন্দ্র হন্তে গণ্ডস্থাপন করিয়া গভীর চিন্তায় মগ্ন রহিয়াছেন।

 যখন চিন্তা-রজ্জু ছিন্ন হইল, একবার বদনমণ্ডল উঠাইয়া সম্মুখে চাহিয়া দেখিলেন। কি দেখিলেন?জেলেখা নিঃশব্দে দণ্ডায়মান রহিয়াছেন। জেলেখার মুখমণ্ডল ও ওষ্ঠদ্বয় পাণ্ডবর্ণ, কেশপাশ আলুলায়িত, বদন বিষন্ন, নয়নদ্বয় জলে ছলছল করিতেছে। নরেন্দ্র দেখিয়া বিস্মিত হইলেন, জিজ্ঞাসা করিল,—“রমণী! আপনি কে জানি না আপনার কি অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়া বলুন।”

 জেলেখা উত্তর করিল না, ধীরে ধীরে একবিন্দু চক্ষের জল মোচন করিল।

 নরেন্দ্র আবার বলিলেন,—“আপনাকে দেখিয়া বোধ হইতেছে, কোন বিপদ বা ভয় সন্নিকট। প্রকাশ করিয়া বলুন, যদি উদ্ধারের উপায় থাকে, আমি চেষ্টা করিব।”

 জেলেখা তথাপি নীরব; নীরবে অশ্রুমোচন করিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল।

 নরেন্দ্র বিস্মিত হইলেন। নিশাযোগে এই সহসা সাক্ষাতের অর্থ কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না। তাহার বোধ হইল যেন, কোন ঘোর সঙ্কট সন্নিকট। তিনি হস্তে গণ্ডস্থাপন করিয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন, অন্যমনস্ক হইয়া নানা বিপদের চিন্তা করিতে লাগিলেন।

 সহসা গৃহের দীপ নির্বাণ হইল, সেই ঘোর অন্ধকারে একজন খোজা আসিয়া নরেন্দ্রকে তাহাব সঙ্গে যাইতে ইঙ্গিত করিল। নরেন্দ্র সভয়ে তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ 'চলিলেন। উভয়ে নিস্তব্ধে কত ঘর, কত প্রাণ যে পার হইয়া গেলেন, তা বলা যায় না। নরেন্দ্র রাজমহলের প্রাসাদ দেখিয়াছিলেন, কিন্তু এরূপ প্রাসাদ কখনও দেখেন নাই। কোথাও শ্বেতপ্রস্তর বিনির্মিত ঘরের ভিতর সুন্দর গন্ধদীপ জ্বলিতেছে, শ্বেতপ্রস্তর স্তম্ভকারে উন্নত ছাদ ধরিয়া রহিয়াছে, স্তম্ভে, ছাদে ও চারিদিকে বহুমূল্য প্রস্তরের ও সুবর্ণ-রৌপ্যের যে কারুকার্য, তাহা বর্ণনা করা যায় না। কোথাও প্রাঙ্গণে ঈষৎ চন্দ্রালোকে সুন্দর ফোয়ারার জল খেলিতেছে, চারিদিকে সুন্দর বাগান, সুন্দর পুষ্পলতা, তাহার উপর দিয়া নৈশ সমীরণ নিস্তব্ধে বহিয়া যাইতেছে। কোথাও বা উদ্যান-বৃক্ষতলে আসীন হইয়া দুই একজন উচ্চবর্ণ উজ্জলবেশধারিণী রমণী বীণা বাজাইতেছে অথবা নিদ্রার বশীভূত হইয়া সুখে নিদ্রা যাইতেছে। বাহিরে

৩১