পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কয়েক বৎসর পূর্বে সম্রাট, শাজাহান সেইস্থানে মূল রাজধানী স্থাপন করিয়া ও সুন্দর প্রাসাদ ও দুর্গ নির্মাণ করিয়া নগরের শাজাহানবাদ নাম দেন। কিন্তু নগরের সে নাম কেহ জানে না। অদ্যাপি শাজাহানের নগর নূতন দিল্লী নামে বিখ্যাত। পৃথুরাজের সময়ের হিন্দু নাম অদ্যাপি পরিবর্তিত হয় নাই।

 দিল্লী একদিকে যমুনা নদী ও অন্য তিনদিকে অর্ধগোলাকৃতিরূপে প্রাচীর দিয়া বেষ্টত। সে প্রাচীর প্রশস্ত ও তাহার উপর দিয়া যাতায়াতের একটি পথ ছিল। যমুনা ও এই প্রাচীরের মধ্যে দিল্লী নগরী সন্নিবেশিত, কিন্তু প্রাচীরের বাহিরেও তিনচারিটি বৃহৎ বৃহৎ পল্লী ও ধনাঢ্য ওমরাহ ও হিন্দুরাজগণের অট্টালিকা ও বাগান অনেক অবধি দেখা যাইত দিল্লীর ভিতরে যমুনার অনতিদূরে প্রস্তাব-প্রাচীর-পরিবেষ্টিত দুর্গ আছে, তাহার ভিতর সম্রাটের প্রাসাদ ও জগতে অতুল্য মর্মর-নির্মিত হর্ম্যাবলী।

 গজপতিও নরেন্দ্র দিল্লীর একটি প্রধান পথ দিয়া দুর্গাভিমুখে যাইতে লাগিলেন। সমস্ত দিল্লীই প্রায় সৈনিকের বাস, সে নগরীতে পঞ্চত্রিংশৎ সহস্র সৈন্তু বাস করিত। সৈনিকগণের স্ত্রী, পরিবার ও বহুসংখ্যক ভৃত্য দিল্লী-নগরীর মৃত্তিকা ও পর্ণকুটীরে বাস করিত, সুতরাং দিল্লী এইরূপ পর্ণকুটীরেই পরিপূর্ণ। যেদিকে দেখা যায়, এইরূপ কুটির শ্রেণীই অধিকাংশ দেখা যায়। খাদ্যদ্রব্য, ও বস্ত্রাদি বিক্রয়ার্থ যে দোকান ছিল, তাহা অধিকাংশ পর্ণকুটীর সর্বদাই অগ্নি লাগিত ও বৎসরে প্রায় বহু সহস্র পর্ণকুটার একেবারে দগ্ধ হইয়া যাইত। নরেন্দ্র দুইধারে এইরূপ কুটীর দেখিতে দেখিতে চলিলেন। দোকানীপশারী নানারূপ দ্রব্য বিক্রয় করিতেছে; পথ লোকারণ্য: অধিকাংশ অতি সামান্য লোক, অতি সামান্য বেশে নিজ নিজ কর্মে যাইতেছে। দিল্লীতে এক্ষণে যেরূপ মধ্যশ্রেণী ব্যবসায়ী ও অন্যান্য লোক ইষ্টকালয় নির্মাণ করিয়া নগর পরিপূর্ণ ও সুশশাভিত করিয়াছে, দুইশত বৎসর পূর্বে তাহা ছিল না। তখন কেবল মহল্লোক বা ইতর লোক ছিল প্রাসাদ বা পর্ণকুটিরে।

 যাইতে খাইতে নরেন্দ্র একটি বড় রাজপথে গিয়া পড়িলেন। সে পথে অনেকগুলি প্রশস্ত ও বড় বড় অট্টালিকা দেখিতে পাইলেন। মন্সবদার, কাজী, বণিক, ওমরাহ, রাজা প্রভৃতি মহল্লোকের শ্রেণীতে পথ সুন্দর দেখাইতেছে। নরেন্দ্র এরূপ অক্ষয় অট্টালিকাশ্রেণী কোথাও দেখেন নাই, প্রাসাদসমূহের পাশ দিয়া যাইতে যাইতে গজপতির সহিত তিনি কথোপকথন করিতে লাগিলেন।

 ক্ষণেক যাইতে যাইতে উভয় প্রসিদ্ধ জুম্মা মস্জিদ দেখিতে পাইলেন। ভারতবর্ষে সেরূপ মস্জিদ আর একটিও ছিল না, বোধ হয় জগতে সেরূপ নাই। নরেন্দ্রনাথ বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “সম্মুখে ঐ বৃহৎ মস্জিদটির নাম কি?”

৩৭