পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ভিতর বিশ্রাম করিতেছে, অপর তীরে এক পর্বতোপরি আওরংজীব ও মোরাদের মোগল সৈন্যদল রহিয়াছে। মধ্যে কলনাদিনী সিপ্রা নদী প্রস্তরশয্যার উপর দিয়া বহিয়া যাইতেছে, যেন মোগল ও রাজপুতদিগের যুদ্ধের আয়োজন দেখিয়া ভীত না হইয়া উপহাস করিয়া যাইতেছে। দূরে ভারতবর্ষের কটিবন্ধনম্বরূপ বিন্ধ্যপর্বত চন্দ্রালোকে দেখা যাইতেছে। কল্য ভীষণ যুদ্ধ হইবে, কিন্তু অন্য সমস্ত জগৎ সুপ্ত। কেবল সময়ে সময়ে প্রহরীর স্বর নিস্তব্ধ রজনীতে সুদূর পর্যন্ত শ্রুত হইতেছে, কেবল সিপ্রা নদীর তরঙ্গমালা কেবল দূর হইতে নৈশ শৃগালের শব্দ নদীকূলে ও পর্বতশ্রেণীতে প্রতিধ্বনিত হইতেছে।

 একটি শিবিরে নরেন্দ্র শয়ন করিয়া নিদ্রিত আছেন, তথাপি যুদ্ধের নানারূপ চিন্তা স্বরূপে তাহার হৃদয়ে জাগরিত হইতেছে, তাহার সঙ্গে সঙ্গে পুরাতন কথা হৃদয়ে জাগরিত হইতেছে। সিপ্রা নদীর কল্-কল্ নাদ যেন ভাগীরথীর শব্দ বোধ হইল, সেই ভাগীরথীতীরে, নেই কুঞ্জবন-বেষ্টিত উচ্চ অট্টালিকা দেখিতে পাইলেন। তীরে বালুকারাশি, বালুকারাশিতে দুইজন বালক ক্রীড়া করিতেছে, আর একজন বালিকা দাঁড়াইয়া যেন গান গাহিতেছে, সে প্রেমপুত্তলী কে? সে কোথায়? ভাগীরথীতীরস্থ কুঞ্জবনে সেই তিনটি শিশু রজনীতে ক্রীড়া করিত সত্য, কিন্তু কালের নিষ্ঠুর গতিতে সে চিত্রটি বিলুপ্ত হইয়াছে।

 স্বপ্ন পরিবর্তিত হইল। ভাগীরথীর কল্লোল নহে, এ রমণীর গীতধ্বনি! রমণী না অপ্সরা? উচ্চ প্রাসাদ তাহার ছাদ ও শুভ সুবর্ণ ও রৌপামণ্ডিত তাহার মধ্যে এক অপ্সরা গান করিতেছে। কেবল একজন অপ্সরা গান করিতেছে, সে বড় দুঃখের গীত, জেলেখা দিয়া দিয়া সে দুঃখের গীত গাহিতেছে। ঐ যে জেলেখা দাঁড়াইয়া আছে। ঐ যে তাহার রত্নরাজি-বিভূষিত কেশপাশে উজ্জ্বল বনমণ্ডল কিঞ্চিৎ আবৃত রহিয়াছে; ঐ যে তাহার নয়নদ্বয় হইতে দুই একবিন্দু জল পড়িতেছে।

 স্বপ্ন পরিবর্তিত হইল। এ জেলেখা নহে, সেই তাতার-বালক গীত গাহিতেছে। যে ব্যর্থ প্রেম করিয়া প্রেমের প্রতিদান পায় নাই, সে দেওয়ানা হইয়া দেশে দেশে বেড়াইতেছে, তাহারই গান। গান শুনিতে শুনিতে নরেন্দ্রের নিদ্রাভঙ্গ হইল। তিনি শিবির হইতে বাহিরে আসিলেন। জগৎ নিস্তব্ধ, দ্বিপ্রহর নিশার বাযু রহিয়া রহিয়া বহিয়া যাইতেছে, চন্দ্রকিরণে নদী, পর্বত, শিবির ও মাঠ দৃষ্ট হইতেছে, আর সেই অভাগা দেওয়ান তাতারবালক শিবিরে বসিয়া উচ্চৈঃস্বরে গান করিতেছে। সপ্তম্বর-মিলিত সে গান বায়ুতে বাহিত হইয়া নৈশ গগনে উখিত হইতেছে ও চারিদিকে আকাশে বিস্তৃত হইতেছে।

 নরেন্দ্র সাশ্রুনয়নে বালকের হস্তধারণ করিয়া তাহার অশ্রুজল মুছাইয়া দিয়া জিজ্ঞাসা

৪৩