পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 আজি আওরংজীব ও মোরাদ দুই ভ্রাতার সাক্ষাৎ হইয়াছে, কালি যুদ্ধ হইবে; জয় জয় নাদে দেশ পরিপূর্ণ হইতেছে। পট্টবস্ত্রমণ্ডিত উৎকৃষ্ট দীপালোকশোভিত একটি প্রশস্ত শিবিরে দুই ভ্রাতা ভোজন করিতে বসিয়াছে, চারিদিকে জগদ্বিমোহিনী নর্তকী ও গায়কগণ নৃত্যগীতাদি করিয়া রাজপুত্রয়ের মনোরঞ্জন করিতেছে। মোরাদের প্রশস্ত ললাট, বিশাল বক্ষস্থল, বীর আকৃতি ও অকপট হৃদয়; আওরংজীবের ললাট কুঞ্চিত, দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ও তীব্র মন সর্বদাই সহস্র চিন্তায় অভিভূত। তথাপি আওরংজীব কি সুন্দর সরল হাসিই হাসিতেছেন, কি সম্মান সহকারে মোরাদের সহিত বাক্যালাপ করিতেছেন, যেন ভ্রাতাকে দেখিয়া তিনি আর অনিন্দ রাখিতে পারিতেছেন না, যেন ভ্রাতার কার্যসাধন অপেক্ষা জগতে তাঁহার অন্ধ আমোদ বা অন্য কোনও প্রকার উদ্দেশ্য নাই।

 ভোজন সাঙ্গ হইল, ভৃত্যেরা ফল ও মদিরা লইয়া আসিল। গায়কীগণ পুনরায় সপ্তস্বরে গান আরম্ভ করিল, শিবির আমোদিত হইল। কেশের হীরকের সহিত কটাক্ষদৃষ্টির জ্যোতি মিশিয়া যাইতে লাগিল, সুললিত গানের সহিত সুমিষ্ট হাস্যধ্বনি মিশিয়া যাইতে লাগিল, মোরাদ একেবারে বিমোহিত হইলেন। অবশেষে আওরংজীবের ইঙ্গিতে নর্তকীগণ চলিয়া গেল।

 আওরংজীব সুবর্ণ-পাত্রে মদিরা ঢালিয়া মোরাদের হস্তে দিয়া বলিলেন, -আজি সেবায় আপনাকে তুষ্ট করিতে পারিয়াছি, আজি আমার জীবন সার্থক।”

 মোরাদ। আওরংজীব, আপনার ন্যায় অমায়িক ভ্রাতা আমি পাইব না। একটু মদিরা আপনার জন্য লউন।

 আওরংজীব। ক্ষমা করুন, আপনি জানেন, আমার জীবনে সুখের বাঞ্ছা নাই। হৃদয়ে বড় মানস আছে, আপনার মতো বীরপুরুষকে পিতৃসিংহাসনে একবার দেখিব, ইহা ভিন্ন আর দ্বিতীয় ইচ্ছা নাই। পৈগম্বর যদি এই এরাদা সফল করেন; তাহা হইলে সন্তুষ্ট মনে ফকিরি গ্রহণ করিয়া মক্কায় যাইব।—এই বলিয়া আওরংজীব আর এক পাত্র মদিরা দিলেন।

 মোরাদ। আওরংজীব, আপনি যথার্থই ধার্মিক, তাহা না হইলে আমার জন্য আপনি এরূপ যত্ন করিবেন কেন?

 আওরংজীব। কাহার জন্য করিব? তৈমুরের সিংহাসনে অধিরূঢ় হইবার উপযুক্ত আর কে আছে। সুজা বিলাসপ্রিয় ও ভীরু, সুজা তৈমুরের সিংহাসন কলঙ্কিত করিবে। আত্মাভিমানী মূর্খ কাফের দারা তৈমুরের সিংহাসন কলুষিত করিবে। তাহা অপেক্ষা পুনরায় হিন্দুস্থান কাফেরদিগের হাতে যাউক, তৈমুরের নাম বিলুপ্ত হউক। ইহাদের জন্য আমি যুদ্ধ করিব না; যাহার সাহস অপরিসীম, যাহার যশোরাশিতে ভারতবর্ষ

৪৬